রবিবার, ৭ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপের ‘না’ বলতে হবে জেফরি ডি স্যাক্স

পোস্ট হয়েছে: জুলাই ১৭, ২০১৮ 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤প। ইরান চুক্তি থেকে ডোনাল্ড ট্রা¤েপর বেরিয়ে যাওয়া এবং ইরানের ওপর নতুন করে অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও চুক্তিটিকে সমর্থন করার ওপর ইউরোপের নিরাপত্তা নির্ভর করছে। রাশিয়া, চীন এবং জাতিসংঘভুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গে এক হয়ে ইউরোপেরও এখন বলার সময় এসেছে যে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের স¤পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব।
এই লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে ইউরোপকে অবশ্যই ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রবহির্ভূত অবরোধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে; অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের দেশগুলোর কো¤পানিগুলোকেও ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করতে না দেওয়া বা তাদের বাণিজ্য সীমিত করে দেওয়ার মার্কিন প্রচেষ্টাকে মোকাবিলা করতে হবে।
ট্রা¤েপর এই চুক্তি ছাড়ার উদ্দেশ্য স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। ¯পষ্টতই তিনি এর মাধ্যমে ইরানের সরকারকে ফেলে দিতে চান। ট্রা¤েপর এই সিদ্ধান্তকে ইউরোপীয় নাগরিকেরা বোকামি হিসেবেই গ্রহণ করেছে এবং তারা বুঝতে পারছে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তা ইস্যুর সংশ্লিষ্টতা খুব একটা নেই।
ইরানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভীতি-প্রদর্শনমূলক পদক্ষেপকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ। একটি ইসরায়েল, অন্যটি সৌদি আরব। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে কোনোভাবেই ফিলিস্তিনিদের একচুলও ছাড় না দিতে বলে আসছে। অন্যদিকে, সৌদি আরবের প্রধান চাওয়া যুক্তরাষ্ট্র যেন ইরানের ওপর চাপ অব্যাহত রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত এই দুটি দেশই এখন চায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানের ওপর হামলা চালাক।
এর আগে মধ্যপ্রাচ্যে শাসন বদল করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে তার খেসারত যুক্তরাষ্ট্রকে একা দিতে হয় নি। ইউরোপকেও এর যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে সরকার পরিবর্তনের মতলবে যুদ্ধ শুরু করার পর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে অভিবাসীদের ঢল ইউরোপের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করে। আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার মতো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছামতো সরকার পরিবর্তন হলেও সেখানে এখনো অস্থিতিশীল অবস্থা রয়ে গেছে। আর সিরিয়ার মতো যেখানে সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে পুরোদমে যুদ্ধ চলছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল অনেক চেষ্টা করেও ট্রা¤পকে চুক্তিতে ধরে রাখতে পারলেন না। তাঁরা যে লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ হবেন, তা আগেভাগেই বলা হচ্ছিল।
মনে হচ্ছে দুটি বিষয়ের কারণে ট্রা¤প এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য আরও বিস্তার করার জন্য ট্রা¤প প্রশাসন আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে এবং দ্বিতীয়ত, ট্রা¤েপর মতিচ্ছন্ন মনস্তত্ত্ব। ইউরোপীয় নেতাদের অপ্রস্তুত করে ট্রা¤প যে আনন্দ পান, তা তিনি বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন।
তবে ইউরোপীয় দেশগুলোর হাতে যে একেবারেই কোনো ক্ষমতা নেই তা নয়। যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলেও ইরান চুক্তি এখনো বহাল রয়েছে। কেননা, এটি শুধু ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি নয়। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী সদস্যদেশগুলোর অনুমোদনে এই চুক্তি হয়েছে। বরং ট্রা¤প একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছেন।
এই চুক্তিতে সই করার পর থেকেই ইরান তার পরমাণু কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে এবং এই চুক্তির সুবাদেই তার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক স¤পর্ক আস্তে আস্তে স্বাভাবিকতার দিকে যাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলেও এখনো এই চুক্তি বাকি বিশ্বের সমঝোতার দলিল হিসেবেই টিকে আছে। এখন বাকি বিশ্বকে যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অবরোধ চাপাতে বাধ্য করতে পারে (যেটিকে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রবহির্ভূত অবরোধ), তাহলে ইরান চুক্তি কার্যত ভেঙে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র সেটিই চাইছে।
কিন্তু বিশ্বশান্তির দিকে চেয়ে হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তাদের বলতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র না চাইলে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে না, কিন্তু সে কাউকে ইরানের সঙ্গে স¤পর্ক রাখার বিষয়ে বাধা দিতে পারবে না।
সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কো¤পানি ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেখানে ব্যবসা করতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। ইরানের কো¤পানিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখানেই থেমে থাকতে চায় না। অন্য দেশগুলোও যাতে ইরানকে নিষিদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র সেই চেষ্টা করছে। ইউরোপের দেশগুলোকেও সে এর আওতায় রাখার চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপকে রুখে দাঁড়াতে হবে। তাদের যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিতে হবে, ট্রা¤েপর হঠকারী সিদ্ধান্তের চেয়ে তাদের প্রতিশ্রুতির দাম অনেক বেশি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রবহির্ভূত অবরোধে তাদের ¯পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের মুখের ওপর ‘না’ বলে দিতে হবে। তাদের বলতে হবে এ ধরনের অবরোধ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। তাদের বুঝতে হবে, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিলে ট্রা¤পকে যুদ্ধ ও শান্তির একক ইজারা দিয়ে দেওয়া হবে; জাতিসংঘের হাতে কোনো ক্ষমতা থাকবে না। বৈশ্বিক বাণিজ্যের রীতিনীতি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার হাত থেকে ট্রা¤েপর হাতেই চলে যাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ইউরোপ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের সহায়তা চাইতে পারে। যেসব স্থানে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করতে ইউরোপের অসুবিধা আছে, সেখানে সহজেই চীন ব্যবসা করতে পারে। আইনগতভাবে চীনের সে অধিকার রয়েছেও।
ইউরোপের সামনে এখন কোনো আইনগত কিংবা ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ নেই। যেটি আছে সেটি হলো মনস্তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ। ইউরোপের নেতারা এমন আচরণ করছেন যা দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা এখনো ভাবেন তাঁদের ভালো-মন্দ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মাথা ঘামায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যুক্তরাষ্ট্র এখন আর সে জায়গায় নেই। তাই এখনই ইউরোপকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, জাতিসংঘ সনদ ও বিশ্ববাণিজ্য নীতি রক্ষায় ইউরোপের ভূমিকার ওপর বিশ্বশান্তি নির্ভর করছে; ট্রা¤েপর একগুঁয়েমির ওপর নয়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।
জেফরি ডি স্যাক্স কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক
সূত্র: প্রথম আলো, ১ জুন, ২০১৮