রবিবার, ৭ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)’ ছায়াছবি দর্শকদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত

পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ২৫, ২০১৬ 

মো. আশিকুর রহমান
অস্কার মনোনীত ইরানের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পরিচালক মাজিদ মাজিদির নির্মিত মহানবী (সা.)-এর জীবনালেখ্যভিত্তিক ছায়াছবি ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)’ বিশ্বের দর্শকদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। প্রদর্শনী শুরু হওয়ার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ছবিটি ১০ এর মধ্যে ৮.৯ রেটিং অর্জন করেছে। চলচ্চিত্র বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো এ হিসাব দিয়েছে।
মহানবী (সা.)-কে নিয়ে নির্মিত ট্রিলজি বা তিন খণ্ডের ছায়াছবির এই প্রথম খণ্ডে তাঁর মক্কার জীবনালেখ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১৭১ মিনিটের এ ছায়াছবি নির্মাণে সাত বছর সময় লেগেছে। ইরানের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ ছবি নির্মাণে ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। মুহাম্মাদ মাহদি হায়দারিয়ান প্রযোজিত এ ছবির চিত্র ধারণ করা হয়েছে ইরান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার শহর বেলা-বেলাতে।
ছবিটি নির্মাণে চলচ্চিত্র জগতের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা সহযোগিতা করেছেন। এতে কাজ করেছেন ইতালির তিনবারের অস্কার জয়ী সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারো, ইতালির ফিল্ম এডিটর রোবাতো পেরপিগানি, মার্কিন ¯েপশাল এফেক্ট শিল্পী স্কট ই অ্যান্ডারসন, ইতালির মেকআপ আর্টিস্ট গিয়ানেত্তো ডি রোসি এবং ভারতীয় প্রখ্যাত সুরকার আল্লা রাখা রহমান (এ আর রহমান)।
এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘২০০৬ সালে এমন একটি ফিল্ম নির্মাণের চিন্তা করি। ২০০৬ সালে যখন কয়েকজন ড্যানিশ কার্টুনিস্ট মহানবী (সা.)-কে ব্যঙ্গ করে কার্টুন ছাপে তখন তার প্রতিবাদে ড্যানিশ ফিল্ম ফেস্টিভাল থেকে আমার ‘দি উইলো ট্রি’ ছবিটি প্রত্যাহার করে নিয়ে আমি সেই ফেস্টিভাল বর্জন করি।’ জনাব মাজিদি বলেন, ‘তখন থেকেই আমি মহানবী (সা.)-এর অবমাননার প্রতিবাদে আরো বাস্তবধর্মী কোন কর্মসূচির কথা চিন্তা করতে থাকি।… অজ্ঞতা ও ইসলামভীতির বিপক্ষে ইসলামের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাই। যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামের একটি খারাপ চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস চালাচ্ছে।… ইসলামী বিশ্বের সবার মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে আমি চেষ্টা করেছি। মহানবীর জীবনীভিত্তিক এ চলচ্চিত্র নির্মাণে সবার কাছে স্বীকৃত ইতিহাসের ওপরই আমি নির্ভর করেছি।’
উল্লেখ্য, পরিচালক মাজিদ মাজিদি ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখা, সংশোধন ও চূড়ান্ত করার আগে বড় বড় বিশেষজ্ঞ আলেমের সাথে আলোচনা করেন যাঁদের সকল মাযহাব ও চিন্তাধারার আলোকে মহানবী (সা.)-এর জীবনীর ওপর লেখা পুস্তকের ওপর গভীর পাণ্ডিত্য রয়েছে।
গত ২৭ আগস্ট ২০১৫ ইরানের রাজধানী তেহরানসহ ১১ শহরের ১৪৩টি প্রেক্ষাগৃহে এই ছায়াছবির প্রথম পর্বের প্রদর্শনী শুরু হয়। একই সময়ে কানাডার মন্ট্রিল চলচ্চিত্র উৎসবের আওতায় সেখানকার দুটি সিনেমা হলে দেখানো হয় ইরানের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই ছায়াছবি। ইরানে প্রদর্শনীর টিকিট বিক্রি থেকে প্রথম রাতেই উঠে আসে ২০০ কোটি ইরানী রিয়াল।
৩৯তম আন্তর্জাতিক মন্ট্রিল ফিল্ম ফেস্টিভালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)’ ফিল্মটি প্রদর্শিত হয়। ব্যাপক দর্শক চাহিদার দিকে তাকিয়ে আয়োজক গোষ্ঠী ফেস্টিভাল চলাকালে (২৭ আগস্ট – ৭ সেপ্টেম্বর) আবারো প্রদর্শনীর আয়োজন করে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ট্রিল আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভালের প্রেসিডেন্ট সার্জ লোসিক বলেন, ‘আমরা গর্বিত যে, এমন একটি উচ্চমার্গের ও উচ্চ শিল্পমানসমৃদ্ধ ফিল্মের অংশগ্রহণে এবারের ফেস্টিভাল শুরু হলো, যা ব্যাপক দর্শকগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করবে।’ তিনি বলেন, ‘অতীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, যেমন মূসা, ঈসা, গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, কিন্তু ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে এটি মাত্র দ্বিতীয় ফিল্ম নির্মিত হলো।’
চলচ্চিত্র ও টিভি অনুষ্ঠান সংক্রান্ত জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য উৎস ইন্টারন্যাশনাল মুভি ডাটাবেজ বা আইএমডিবি’র হিসাব অনুযায়ী, বিশাল বাজেটের এ চলচ্চিত্রটি দর্শকরা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন। আইএমডিবি’র ওয়েবসাইটে এ ছবি নিয়ে নিজেদের আনন্দ অনুভূতি তুলে ধরতে দ্বিধা করেন নি পরিতৃপ্ত দর্শকরা। এক দর্শক লিখেছেন, ‘শেষ ছবি নির্মাণের আট বছর পর আবারও চমক দেখালেন মাজিদ মাজিদি। এবারে তাঁকে ছবি নির্মাণে সহায়তা করেছেন চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতিমান অনেকেই; ক্যামেরার পেছনে ছিলেন তাঁরা। তাঁদের নিয়েই মহানবীর শিশুকালের ওপর ভিত্তি করে ছবি তৈরি করেছেন মাজিদ মাজিদি।’
ছবিটির এ দর্শক আরো লিখেছেন, ‘এ পর্যন্ত যেসব ছবি দেখেছি তার মধ্যে সিনেমাটোগ্রাফির দিক থেকে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ। চলচ্চিত্রটিতে কম বয়সী নায়কের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা যেন উড়ে বেড়িয়েছে।’ ছবিটি দেখতে গিয়ে গ্যালারিতে অনবদ্য চিত্রকলা দেখার অনুভূতি হয় বলে মন্তব্য করেন এ দর্শক।
কানাডার অপর এক দর্শক আইএমডিবি’তে লিখেছেন, ‘আর্ট ফিল্মের জগতের রাজাধিরাজ হলেন মাজিদ মাজিদি। ইরানের অনেক বড়মাপের এ সিনেমা প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়েছে তাঁকে। এ ছবি দর্শককে বিচিত্র রঙের লহরীতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর মহিমান্বিত সুর লহরী নির্মাণই মাজিদ মাজিদির বৈশিষ্ট্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারোর কুশলী তৎপরতা। তবে কোথাও কোথাও তাঁর কাজ মাত্রা অতিক্রম করেছে বলেও মনে হতে পারে। সব মিলিয়ে যে চিত্রকল্প তৈরি করতে চেয়েছিলেন তা নান্দনিকভাবেই শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছেন মাজিদ মাজিদি।’
এ ছবিটি নির্মাণ প্রসঙ্গে পরিচালক মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘ইসলামের সঠিক ভাবমর্যাদা বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছে ছায়াছবি ‘মুহাম্মাদ (সা.)’।
মন্ট্রিলে এ ছবির প্রিমিয়ারে তিনি বলেন, ‘দুভার্গ্যক্রমে এখন ইসলামের নামে উগ্র এবং সহিংস রূপ তুলে ধরা হচ্ছে, অথচ এটি ইসলামের পরিচয় নয়। ইসলামের ছদ্মাবরণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরা যে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনো স¤পর্কই নেই।’
সিরিয়া ও ইরাকে তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল’র মানুষ হত্যা এবং সাংস্কৃতিক স¤পদ ধ্বংসের কথাই পরোক্ষভাবে বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘শান্তি, বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার ধর্ম ইসলাম। এ ছবিতে আমি তা-ই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ইসলাম স¤পর্কে যাঁরা জানেন না, তাঁদের গবেষণার সূচনা করতে পারে এ ছবি।’
এএফপি’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ৫৬ বছর বয়সী মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পবিত্র ইসলাম ধর্মের সঙ্গে এর কোনো স¤পর্ক নেই।’
সাক্ষাৎকারে মুসলিম বিশ্বে মহানবীর জীবনালেখ্যের ভিত্তিতে নির্মিত ছায়াছবির চাহিদার কথাও তুলে ধরেন তিনি। মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘সৌদি আরবের মতো হাতেগোণা কয়েকটি দেশে এ চলচ্চিত্র নিয়ে সমস্যা থাকতেই পারে। কিন্তু তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই এ ছবির বিষয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ দেখিয়েছে।’
মহানবীর জীবনীভিত্তিক প্রথম ছায়াছবি নির্মাণ করেছিলেন সিরীয়-আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা আক্কাদ। ওই ছায়াছবির নাম ‘দ্য ম্যাসেজ’। ১৯৭৬ সালে তা মুক্তি পাওয়ার পর মুসলিম বিশ্বের কোনো কোনো মহল তাঁর কঠোর সমালোচনা করেছিল। মহানবী (সা.)-এর জীবনীভিত্তিক ছবি নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিশ্বের কোনো কোনো মুসলমানের উদ্বেগের বিষয়টি অনুধাবন করে মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘ছবিতে বিকল্পভাবে মহান নবীকে উপস্থাপন করা হয়েছে। চলচ্চিত্রে মহানবীর চরিত্রে রূপদানকারী ক্যামেরার দিকে পেছন ফিরে ছিলেন। তাঁর অবয়ব দেখা গেছে। কিন্তু তাঁর চেহারা দেখানো হয়নি।’
বিশ্ববরেণ্য এ চিত্রনির্মাতা সহাস্যে বলেন, ‘পুরো ছবিতে নায়কের দুর্দান্ত উপস্থিতি রয়েছে, কিন্তু তাঁর চেহারা দেখানো হয় নি, সত্যিই এটি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল।’ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় নেন মাজিদি এবং তিনবার অস্কার বিজয়ী ইতালির সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারো।
মাজিদি বলেন, ‘ছায়াছবিতে মহানবীকে তুলে ধরার জন্য বিশেষভাবে তৈরি স্টেডিক্যাম ব্যবহার করা হয়। চলচ্চিত্রটির যে দৃশ্যেই রাসূল (সা.)-কে দেখানো হয়েছে সেখানেই দৃশ্যটি নবীর দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ চলচ্চিত্রের ভাষায় ক্যারের্ক্টাস পয়েন্ট অব ভিউ বা পিওভি থেকে দেখানো হয়েছে।’ এমনকি নবীজির শৈশবের দৃশ্য এভাবে চিত্রায়িত হয়েছে বলে জানান তিনি।
মাজিদি বলেন, ‘চলচ্চিত্রটিতে সবাই মুহাম্মাদ (সা.)-কে দেখার জন্য উদগ্রীব থাকবে, কিন্তু কেউ তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল দেখতে পাবেন না। তাঁর অবয়ব দেখা যাবে বা ক্যামেরার দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেনÑ এমন দৃশ্যই কেবল দেখা যাবে।’
এছাড়া বাকি দুই খণ্ড নির্মাণের ক্ষেত্রে কী সমস্যায় পড়তে হবে তাও তুলে ধরেন তিনি। মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘নবুওয়াত লাভের পর মহানবীর সংলাপ নিয়েও বেশ সমস্যা দেখা দেবে।’ অবশ্য এ সমস্যা উতরানো যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
চলচ্চিত্রটির নির্মাণ ও মুক্তি পাওয়া নিয়ে মুসলিম বিশ্বসহ অন্যান্য জাতি-ধর্মের মানুষের মধ্যেও যেমন ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা ও অধীর আগ্রহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তেমনি একটি বিশেষ মহলের মধ্যে এর বিপরীত চিত্রটিও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এই চলচ্চিত্রের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। কারণ, বিশ্বনবীর যুগান্তরী ও বৈশ্বিক জীবনাদর্শ এবং মানব ইতিহাসে তাঁর সর্বজনীন ভূমিকা যুগে যুগে মানুষকে উৎসাহিত করে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ এই নবীর ব্যাপারে জানতে। এই মহান ও যুগোপযোগী কীর্তিটির বিরুদ্ধে যাঁরা অবস্থান নিয়েছেন, তাঁদের এই অযৌক্তিক বিরোধী অবস্থানের কারণ অনুসন্ধান করে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হলো-
কোন কোন মহল নিছক জাতীয়তাবাদ, মাযহাবগত বিদ্বেষ, রাজনৈতিক অবস্থান প্রভৃতি কারণে উক্ত চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধাচরণের পথ বেছে নিয়েছে।
একদল অজ্ঞ ও অন্ধ ব্যক্তির মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, ইসলামে চিত্র বা চলচ্চিত্র স¤পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাই তারা শিল্প ও প্রচারমাধ্যমটির উদ্দেশ্যের দিকে একেবারেই লক্ষ্য না করে খোদ মাধ্যমটিকেই পরিহার করে চলছে; ফলে তারা ভালো-মন্দ, নৈতিক-অনৈতিক, ধর্মীয়-অধর্মীয়, মার্জিত-অশ্লীল প্রভৃতি সর্বপ্রকারের চলচ্চিত্রকে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করছে ও তার বিরোধিতা করে আসছে।
বিশ্ব যায়নবাদী ও নাস্তিক্যবাদী শক্তিগুলো ও তাদের দালালরা চাচ্ছে না যে, ইসলামের নবী (সা.)-এর ওপর কোন চলচ্চিত্র নির্মিত ও প্রচারিত হোক। কারণ, এতে তাদের গোপন শয়তানি মিশনের অপরিসীম ক্ষতি সাধিত হবে। আবার কেউ কেউ এমন রয়েছে যে, শুধু শুনেই চলচ্চিত্রটির বিরোধিতায় নেমেছে, আবার একই সাথে তারা চলচ্চিত্রটি দেখার ব্যাপারেও আগ্রহী! আসলে তারা অধিক বিরোধিতাকারীদের অপপ্রচার ও অপতৎপরতার প্রভাবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে আশা করা যায় যে, তারা চলচ্চিত্রটি দেখার পর এর বিরোধিতা করা পরিহার করবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো এ পর্যন্ত হযরত ঈসা (আ.)-কে নিয়ে প্রায় ২৫০টি, হযরত মূসা (আ.)-কে নিয়ে প্রায় ১২০টি, অন্য নবী-রাসূলদের নিয়ে প্রায় ৮০টি চলচ্চিত্র এবং গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে প্রায় ৪০টির মতো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে; অথচ সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে চলচ্চিত্রের সংখ্যা দুইয়ের অধিক নয়! অথচ এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ইসলামের নবীর বাণী সঠিকভাবে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে সকল নবী-রাসূলই মুসলমানদের কাছে সম্মানিত। তাহলে অন্য নবী-রাসূলদের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহের ব্যাপারে কোনই আপত্তি ও বিরোধিতা আসছে না, কেবল মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রটির ব্যাপারেই কেন রহস্যজনকভাবে এত আপত্তি ও বিরোধিতা!
কিছুদিন আগে সৌদি আরব ও কাতারের যৌথ উদ্যোগে হযরত উমরের জীবনীভিত্তিক একটি দীর্ঘ সিরিয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে হযরত উমর, হযরত আবু বকর, হযরত উসমানসহ হযরত আয়েশাকেও দেখানো হয়েছে। ওই সিরিজটির ব্যাপারে যারা অত্যন্ত উচ্ছ্বাস প্রদর্শন করেছিল, অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে তারাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চলচ্চিত্রটির ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, যদিও চলচ্চিত্রটিতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মুখাবয়ব দেখানো হয়নি।
কয়েক বছর আগে যখন টেরি জোন্স আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম্স’ নির্মাণ করে তখন মধ্যপ্রাচ্যের গ্রান্ড মুফতি, খতিবগণ ও বাদশাহদের কেউই ওই জঘন্য চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করেননি; অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মানে ও ভালোবাসায় তাঁর মহা পবিত্র জীবনীর ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে নেতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
যায়নবাদীরা ও বিভ্রান্ত খ্রিস্টানরা তাদের বিকৃত আকীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত মূসা (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.)-এর মহান ও পবিত্র চরিত্রকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে বিভিন্ন চলচ্চিত্র বানাচ্ছে। তাঁরা হয়তো সেগুলোর খোঁজও রাখেন না কিংবা জেনেও সে স¤পর্কে কিছুই বলেন না।
আরেকটি বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বিভিন্ন ধারা-উপধারার নেতৃবৃন্দও তাঁদের কর্মসূচিসমূহের ব্যাপারে নানা রকম ভিডিও ডকুমেন্টারি, চলচ্চিত্র, ভিজুয়াল রিপোর্ট প্রভৃতি নিজেরাই নির্মাণ ও প্রচার করে থাকেন। তাঁদের নেতাদের বায়োগ্রাফি টাইপের ভিডিও প্রচার করে এরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট থাকলেও সন্দেহজনকভাবে রাসূল (সা.)-এর মহান বায়োগ্রাফি প্রচার করলে তাঁরা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন।
ইসলামী ইরান এর আগেও বিভিন্ন নবী-রাসূলের জীবনীর ওপর চলচ্চিত্র ও সিরিয়াল নির্মাণ করেছে। যেমন হযরত ইউসুফ (আ.), হযরত ঈসা (আ.), হযরত সুলাইমান (আ.), হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত আইয়ুব (আ.) প্রভৃতি। এসব চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে কখনই কোন প্রতিবাদ করা হয় নি, অথচ ‘মুহাম্মাদ (সা.)’ চলচ্চিত্রটির বিরোধিতা করা হচ্ছে!
মোদ্দা কথা, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, বিশ্ববিখ্যাত ইরানী চলচ্চিত্র নির্মাতা মাজিদ মাজিদির নির্মাণ করা ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)’ চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র চলছে; আর এই ষড়যন্ত্রের মূল কারণ কখনও রাসূলবিদ্বেষ, কখনও শিয়াবিদ্বেষ, আবার কখনও বা ইরানবিদ্বেষ…
যদিও নবী-রাসূলগণের জীবনীর উৎস হচ্ছে পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ইতিহাসভিত্তিক সিরাত গ্রন্থসমূহ। আর চলচ্চিত্র হচ্ছে সেই জীবনী জানার ও প্রচারের একটি মাধ্যম মাত্র, তা নিজেই কোন মৌলিক উৎস নয়। যেভাবে বর্তমানে পবিত্র কুরআনের ঊষবপঃৎড়হরপ ঝড়ভঃ ঈড়ঢ়ু বের হয়েছে, যেভাবে হাদিসসমূহ এখন ডবন ঝবৎাবৎ এ পাওয়া যায়, সেভাবেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র জীবনী এখন ঊষবপঃৎড়হরপ ঠবৎংরড়হ এর মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। এটা সিরাত গ্রন্থেরই একটি আধুনিক ও শক্তিশালী রূপ। যেহেতু ধর্ম প্রচার একটি দীর্ঘমেয়াদি চলমান ও গতিশীল প্রক্রিয়া সেহেতু এতে নতুন ও আধুনিক মাত্রা যোগ হবে এটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
উপরন্তু এই চলচ্চিত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারা মুবারক মোটেও দেখানো হয়নি। আর এতে যদি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি অবমাননাকর কিছু প্রদর্শন করা হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তার প্রতিবাদ করা উচিত।
আশা করি চলচ্চিত্রটি মুসলমানদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্ত হবে ও মাযহাবগত সংকীর্ণতার গণ্ডি পেরিয়ে ইসলাম প্রচারের মাধ্যম হবে; কারণ, যাঁর মহা পবিত্র জীবনীর ওপর চলচ্চিত্রটি বানানো হয়েছে, তিনি শিয়া-সুন্নি, মুসলিম-খ্রিস্টান, সাদা-কালো, আরব-অনারব সব ধরনের সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও মহান আল্লাহ পাকের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তি- মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)।