বৃহস্পতিবার, ৪ঠা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২০শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

নারীর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা

পোস্ট হয়েছে: জুন ১৫, ২০২১ 

প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মানবাধিকার সনদের দর্পণে
নারীর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা
ড. এম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

[২০শে জমাদিউসসানি নবীনন্দীনি খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা যাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা)’র পবিত্র জন্ম বার্ষিকী এবং ইসলামি নারী দিবস উপলক্ষে প্রবন্ধটি লিখিত]
নর ও নারীতে গঠিত মানবজাতিই সৃষ্টির সেরা। আল-কোরআন যখন মানব জাতির এ শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দেয় তখন নর ও নারী উভয়ের স্ব-প্রকৃতির বিচার করেই কথা বলে। এ কারণে আল-কোরআনের নির্দেশাবলি আর প্রকৃতির নির্দেশাবলির মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য বিদ্যমান। বাস্তবিকপক্ষে নর আর নারী হচ্ছে মনুষ্যত্বের আকাশে দুইটি আলাদা ধ্রুবতারার নাম, প্রত্যেকে স্ব স্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণরত। আল-কোরআনের ভাষায় : ‘সূর্যের জন্য সমীচীন নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া আর রাত্রের জন্য সমীচীন নয় দিবসকে অতিক্রম করা। প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণরত।’ অতএব, কোরআনের আলোকে মানবসমাজের বাস্তবতায় নর ও নারীর সৌভাগ্যের প্রধান শর্তই হচ্ছে এতদুভয়ের প্রত্যেকেই নিজ কক্ষপথে থেকে পূর্ণতার যাত্রা অব্যাহত রাখা।
নারী পুরুষের স্বাধীনতার কথা বলি আর সমঅধিকারের কথাই বলি, সেটা তখনই সুফল বয়ে আনবে যখন এদের কেউই তার নিজস্ব প্রাকৃতিক কক্ষপথ ও সহজাত গতিপথ থেকে বের হয়ে না যাবে। কারণ, যখনই সে প্রাকৃতিক ও সহজাত নির্দেশাবলির বিরুদ্ধে চলবে তখনই সমাজে অশান্তির কারণ সৃষ্টি হবে। উপরন্তু নারীর এই প্রাকৃতিক ও সহজাত অবস্থার প্রতি বে-খেয়াল হওয়ার ফল হবে তার অধিকার পদদলিত হওয়া। কেননা, যদি নারীর বিপরীতে অধিকারের দাবি নিয়ে পুরুষ দাঁড়িয়ে যায় এবং ঘোষণা করে যে, হে নারী! তুমিও একজন আর আমিও একজন। কাজেই যত কাজকর্ম, দায়-দায়িত্ব, সুযোগ-সুবিধা কিংবা পুরস্কার ও শাস্তি রয়েছে, সবই একরূপ ও একসমান হতে হবে; সেক্ষেত্রে নারীকে সকল কঠিন ও ভারী কাজে পুরুষের সাথে পাল্লা দিতে হবে এবং তার কর্মক্ষমতার উপযুক্ত পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে হবে। পুরুষের কোনোই সম্মান ও সমর্থনের প্রত্যাশা সে রাখতে পারবে না। তার নিজের জীবনযাপনের সমুদয় খরচাদি নির্বাহের ভার নিজের কাঁধেই তুলে নিতে হবে এবং সন্তানাদির ভরণ-পোষণের খরচেও পুরুষের সাথে অংশীদার হতে হবে…। এমতাবস্থায় নারী নিশ্চয়ই কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হবে। কেননা, স্বভাবতই নারীর উৎপাদন ক্ষমতা পুরুষের চেয়ে কম, অথচ তার খরচ বেশি।
সুতরাং ইসলাম পুরুষ ও নারী প্রত্যেকের প্রাকৃতিক ও সহজাত অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে এবং মানবসত্তা ও মানবাধিকার প্রশ্নে তাদের একসমান ও অভিন্ন হওয়ার প্রতি খেয়াল রেখে নারীকে অত্যন্ত উপযুক্ত এক স্থান দান করেছে, যে স্থানে তার ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণœ হতে হয় না, ব্যক্তিত্বও থাকে অটুট। তাই নারী অধিকার পুনরুজ্জীবিতকরণে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতির পথনির্দেশনাকে অনুসরণ করবে, সেই মতবাদই আক্ষরিক অর্থে নারী অধিকার আন্দোলনে সফলতা লাভ করবে।
প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আল্লামা তাকী জা’ফারী নারীর এই প্রাকৃতিক ও সহজাত ব্যক্তিত্বের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘যদিও ইতিহাসকাল জুড়ে নারীরা দুঃখ-কষ্ট ও কঠিন দুরবস্থার মধ্যে কাটিয়েছে, কিন্তু যে নারীই মানসিক ভারসাম্যতার অধিকারিণী থাকবে, সে তার নারী হয়ে জন্মানোর কারণে কোন দুঃখ ও দোষ অনুভব করবে না। নারীরা সামাজিক চাপসমূহের কথা ব্যতিরেকে কখনই প্রকৃতির কাছে ফরিয়াদ জানায়নি যে, তাদের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করা হোক কিংবা তাদেরকে অন্য কোনোরূপে সৃষ্টি করা হোক। কারণ, নারীর প্রকৃতিতে এমন অনেক মাহাত্ম্য নিহিত রয়েছে যেগুলো অনুধাবন করার সাধ্য পুরুষের নেই…।’ অবশ্য তিনি নারীর এই মাহাত্ম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব উপভোগের জন্য একটা শর্ত রেখে বলেছেন : ‘নারীদেরকে তাদের নিজেদের নারীত্বের প্রতি ঈমান থাকা চাই। সে যেন নিজের অস্তিত্বের বহুমাত্রিকতাকে উপেক্ষা না করে এবং অযথাই পুরুষের সঙ্গে নিজের তুলনা না করে। নারী আর পুরুষ উভয়ের উচিত পরিবারের গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখা। তাদের জানতে হবে যে, সমাজ ও জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় পরিবার।’
১৯১২ সালে নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত ফরাসি শৈল চিকিৎসক ও শরীরতত্ত্ববিদ অষবীরং ঈধৎৎবষ (১৮৭৩-১৯৪৪) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ গধহ, ঃযব টহশহড়হি এর মধ্যে লিখেছেন : ‘প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী নারী ও পুরুষকে যেমন পরস্পর থেকে পৃথক করে সৃষ্টি করা হয়েছে, তেমনি এ পার্থক্য তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকারেরও পার্থক্য সৃষ্টি করেছে… এই প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য না রাখার কারণেই নারী আন্দোলনের সমর্থকরা মনে করে যে, নারী ও পুরুষ উভয়ই একই ধরনের শিক্ষা লাভ ও পেশা অবলম্বন এবং অভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। নারী অনেক দিক থেকেই পুরুষ থেকে আলাদা ….এ পার্থক্য কেবল তাদের যৌনাঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট পার্থক্য এবং নারীর ডিম্বাশয় থাকা ও সন্তান জন্মদান করতে পারা, আর এজন্য তাদের বিশেষ ধরনের শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়… শরীরবৃত্তিক বিধি-বিধানসমূহ নক্ষত্রীয় জগতের বিধি-বিধানেরই মতোই অলঙ্ঘনীয়। এতে মানুষের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এগুলোকে যেমন আছে তেমনভাবেই গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই। পুরুষদের অন্ধ অনুকরণ না করে প্রকৃতি নারীকে যা দান করেছে তার ভিত্তিতেই তাকে স্বীয়-প্রকৃতি নির্ধারিত পথে চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। মানবজাতির পূর্ণতার পথে তার দায়িত্ব পুরুষের তুলনায় অনেক বড়। এ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া কিংবা পরিত্যাগ করা তার সাজে না।’ মি. ক্যারেল এ অধ্যায়ের উপসংহার টেনে বলেন : ‘আমরা যেন যুবতীদের জন্য যুবকদের অনুরূপ চিন্তাপদ্ধতি, একই ধারার জীবন এবং অভিন্ন লক্ষ্য ও আদর্শ নির্ধারণ না করি। শিক্ষাবিষয়ক বিশেষজ্ঞগণকে অবশ্যই নারী ও পুরুষের মধ্যকার দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য এবং তাদের প্রাকৃতিক দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা মনে রাখতে হবে। এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখা আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রাচ্য ও প্রতীচ্য মানবাধিকার প্রশ্নে গবেষণা ও আন্দোলনে পিছিয়ে ছিল না কখনো। ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) ১৯৯০ সনে কায়রো সম্মেলন থেকে মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করে, যা মোটামুটি ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির ধারক। পক্ষান্তরে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্ব মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয় ১৯৪৮ সনে, যেখানে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির প্রাবল্যই বেশি। আমরা যদি এই দুই বিশ্ব সংস্থার মানবাধিকার সনদে নারীর স্থান অনুসন্ধান করি তাহলে দেখা যাবে নারীর ব্যক্তিত্বের স্বরূপ এবং তার অধিকার সংক্রান্ত প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু সাদৃশ্য যেমন বিদ্যমান, তদ্রƒপ কিছু বৈসাদৃশ্যও দৃষ্টিগোচর হয়। ওআইসি মানবাধিকার সনদের ৬(ধ)- ধারায় বলা হয়েছে : ডড়সধহ রং বয়ঁধষ ঃড় সধহ রহ যঁসধহ ফরমহরঃু, ধহফ যধং ৎরমযঃং ঃড় বহলড়ু ধং বিষষ ধং ফঁঃরবং ঃড় ঢ়বৎভড়ৎস; ংযব যধং যবৎ ড়হি পরারষ বহঃরঃু ধহফ ভরহধহপরধষ রহফবঢ়বহফবহপব, ধহফ ঃযব ৎরমযঃ ঃড় ৎবঃধরহ যবৎ হধসব ধহফ ষরহবধমব. আর ৬(ন)- ধারায় বলা হয়েছে : ঞযব ঐঁংনধহফ রং ৎবংঢ়ড়হংরনষব ভড়ৎ ঃযব ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ ধহফ বিষভধৎব ড়ভ ঃযব ভধসরষু.
এদিকে ৫(ধ) ধারায় বলা হয়েছে : ঞযব ভধসরষু রং ঃযব ভড়ঁহফধঃরড়হ ড়ভ ংড়পরবঃু, ধহফ সধৎৎরধমব রং ঃযব নধংরং ড়ভ রঃং ভড়ৎসধঃরড়হ. গবহ ধহফ ড়িসবহ যধাব ঃযব ৎরমযঃ ঃড় সধৎৎরধমব, ধহফ হড় ৎবংঃৎরপঃরড়হং ংঃবসসরহম ভৎড়স ৎধপব, পড়ষড়ঁৎ ড়ৎ হধঃরড়হধষরঃু ংযধষষ ঢ়ৎবাবহঃ ঃযবস ভৎড়স বহলড়ুরহম ঃযরং ৎরমযঃ. আর ৫(ন) ধারায় বলা হয়েছে : ঝড়পরবঃু ধহফ ঃযব ঝঃধঃব ংযধষষ ৎবসড়াব ধষষ ড়নংঃধপষবং ঃড় সধৎৎরধমব ধহফ ংযধষষ ভধপরষরঃধঃব সধৎরঃধষ ঢ়ৎড়পবফঁৎব. ঞযবু ংযধষষ বহংঁৎব ভধসরষু ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ ধহফ বিষভধৎব.
অপরদিকে জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদেও ১৬ নং ধারায় উপস্থাপিত বক্তব্যের তিনটি পয়েন্ট হচ্ছে :
(ধ) গবহ ধহফ ড়িসবহ ড়ভ ভঁষষ ধমব, রিঃযড়ঁঃ ধহু ষরসরঃধঃরড়হ ফঁব ঃড় ৎধপব, হধঃরড়হধষরঃু ড়ৎ ৎবষরমরড়হ, যধাব ঃযব ৎরমযঃ ঃড় সধৎৎু ধহফ ঃড় ভড়ঁহফ ধ ভধসরষু. ঞযবু ধৎব বহঃরঃষবফ ঃড় বয়ঁধষ ৎরমযঃং ধং ঃড় সধৎৎরধমব, ফঁৎরহম সধৎৎরধমব ধহফ ধঃ রঃং ফরংংড়ষঁঃরড়হ.
(ন) গধৎৎরধমব ংযধষষ নব বহঃবৎবফ রহঃড় ড়হষু রিঃয ঃযব ভৎবব ধহফ ভঁষষ পড়হংবহঃ ড়ভ ঃযব রহঃবহফরহম ংঢ়ড়ঁংবং.
(প) ঞযব ভধসরষু রং ঃযব হধঃঁৎধষ ধহফ ভঁহফধসবহঃধষ মৎড়ঁঢ় ঁহরঃ ড়ভ ংড়পরবঃু ধহফ রং বহঃরঃষবফ ঃড় ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ নু ংড়পরবঃু ধহফ ঃযব ঝঃধঃব.
দেখা যাচ্ছে উভয় সনদে অকপটে স্বীকার করা হয়েছে যে, পরিবারই হচ্ছে সমাজের প্রাকৃতিক ও মৌলিক স্তম্ভ। কাজেই পরিবারের ভিতকে দুর্বলকারী যে কোনো মতাদর্শ ও জীবনাচার মনুষ্য প্রকৃতির বিরুদ্ধ মতবাদ হিসাবে চিহ্নিত ও প্রত্যাখ্যাত হবে। এখানে উভয় সনদের ভাষ্যে অভিন্ন কিছু দিক পাওয়া যায়। যথা :
১- নারী ও পুরুষ মানবীয় ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে একসমান। এক্ষেত্রে পরস্পরের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
২- নারী সামাজিক ব্যক্তিত্বসম্পন্না এবং পুরুষের মতোই মানবিক ব্যক্তিত্ব সহকারে বাঁচার অধিকার রাখে। পুরুষের মতোই সে সকল জীবনোপকরণ ভোগ এবং সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারবে।
৩- পুরুষের ন্যায় নারী তার নিজের অর্থ-সম্পদ সঞ্চালন ও প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে স্বাধীন। যদিও পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির মানবাধিকার সনদে এ বিষয়টা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবে পশ্চিমা বিশ্বে বলবৎ মানবাধিকার সংক্রান্ত অপরাপর সূত্রের বরাতে প্রতিপন্ন হয় যে, সেখানে নারী অর্থ-সম্পদ সংক্রান্ত এই অধিকারটি সুরক্ষিত রয়েছে।
৪- বিবাহ অবশ্যই উভয়পক্ষের (নারী ও পুরুষের) পূর্ণ সম্মতি ও স্বাধীনতা সহকারে সম্পন্ন হতে হবে।
৫- পরিবার হচ্ছে সমাজের প্রাকৃতিক ও ভৌতিক স্তম্ভ। এমর্মে সমাজ ও রাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন লাভের অধিকার পরিবারের রয়েছে।
এবার প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দৃষ্টিভঙ্গির বৈসাদৃশ্য নিয়ে পর্যালোচনা করা যাক :
এক : ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর জন্য স্বামী নির্বাচনে এবং একইভাবে পুরুষের জন্য স্ত্রী নির্বাচনে ধর্মের বিষয়টি মান্য করে চলা উচিত। এ বিধানটির কারণও খুবই স্পষ্ট। কেননা, ইসলাম হচ্ছে ফিতরাত তথা সহজাতগত ধর্ম। যে কেউ সত্যিকার অর্থে এই ধর্মের ছায়াতলে আসে, সে বাস্তবিকপক্ষে তার নিজের সহজাত প্রবৃত্তিকেই ফলপ্রসূ করে। একারণে এরূপ ব্যক্তির পক্ষে যে মানুষটি ইসলাম ভিন্ন অন্য কোনো পথে তার ফিতরাত ও আকাক্সক্ষাকে চালিত করে তার সাথে মনস্তÍাত্ত্বিক, ব্যক্তিত্বগত ইত্যাদি কোনো দিক থেকেই পূর্ণরূপে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। ফলে তার সাথে নিখাঁদ অনুরাগ ও ভালোবাসাও বিনিময় করতে সক্ষম হয় না।
অপরদিকে ইসলাম যেহেতু সঠিক খোদায়ী ধর্ম ব্যতীত জীবনকে ব্যাখ্যাযোগ্য কোনো জীবন বলে মনে করে না। কাজেই যে জীবন ব্যাখ্যার অযোগ্য ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সেটাকে যুক্তিযুক্ত বলে গ্রহণ করার কোনো কারণ নেই। বিবাহের ক্ষেত্রে যে জিনিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো সন্তানাদির বিষয়টি। ইসলাম এই দুনিয়াকে একটি ক্ষণস্থায়ী নিবাস বলে মনে করে, যার পশ্চাতে অপেক্ষা করছে এক অনন্তকালীন জীবন। আর সেই জীবনের জন্য মানুষের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ তথা পক্বতা অর্জন করার স্থান হচ্ছে এই দুনিয়া। অতএব, ইসলাম কোনো মতেই এই দুনিয়ায় আগমনকারী মানুষদেরকে পশুদের ন্যায় দায়-দায়িত্বহীন জীবন পার করার জন্য ছেড়ে দিতে পারে না। বরং ইসলাম মানব সন্তানদেরকে সঠিক আকিদা বিশ্বাস সহকারে একটি মানবিক ও ঐশী আলোয় গড়া জীবনের জন্য যথোপযুক্ত দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের জোরালো নির্দেশ প্রদান করে থাকে। এমতাবস্থায় যদি স্বামী-স্ত্রীর কোনো এক পক্ষ মুসলমান না থাকে, তাহলে সন্তানদের ক্ষেত্রে এমন কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয় যার কোনো সমাধান নেই। এরূপ নমুনা চোখের সামনেই রয়েছে অনেক। এ ধরনের বিবাহের কারণে অধিকাংশ সন্তানই ধর্মবোধ ও বিশ্বাস ছাড়াই জীবনযাপনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যা ক্রমান্বয়ে নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত এক উচ্ছৃঙ্খল বস্তুবাদী ও ভোগবাদী জীবনাচারের সূত্রপাত ঘটায় এবং মানবিক মূল্যবোধগুলো মূল্যহীন হয়ে পড়তে থাকে। আজকের পাশ্চাত্য দুনিয়া যার সাক্ষাৎ প্রমাণ। কারণ, পাশ্চাত্যে ইসলামের ন্যায় নারীর জন্য স্বামী নির্বাচনে এবং একইভাবে পুরুষের জন্য স্ত্রী নির্বাচনে ধর্মের বিষয়টি মান্য করে চলার কোনো তাগিদ নেই।
দুই. জাতিসংঘ সনদে উদ্ধৃত … ঞযবু ধৎব বহঃরঃষবফ ঃড় বয়ঁধষ ৎরমযঃং ধং ঃড় সধৎৎরধমব… ‘অর্থাৎ নারী ও পুরুষ বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে একসমান অধিকার রাখে’Ñ এই বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পশ্চিমা মানবাধিকার সনদে বিবাহের মোহরানা, ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য জীবনোপকরণের ভার পুরুষের দায়িত্বে নেই। অথচ ইসলাম এ দায়িত্বগুলো পুরুষের উপর ন্যস্ত করেছে। আর নারীদের উপর ন্যস্ত করেছে আবেগ, অনুরাগ, মমতা ও জীবনের পবিত্র অনুভব দিয়ে পরিবার নামক নীড়কে শান্তিতে ভরে তোলার দায়িত্ব। স্বভাবতই এই অফুরান প্রাণশক্তি নিহিত রয়েছে শুধু নারীর কোমল হৃদয়ের নিখাঁদ প্রাণস্পন্দে। তাই পরিবারকে সুখময় করে তোলার ক্ষেত্রে ইসলাম এভাবে পূর্ণ ন্যায্যতার সাথে দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছে নারী আর পুরুষের মাঝে। পুরুষ জোগান দেবে বৈষয়িক ও বস্তুগত রসদ; আর নারী জোগান দেবে মানবিক ও অবস্তুগত রসদ।
তিন. জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের উপরিউক্ত একই ধারায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে : ঞযবু ধৎব বহঃরঃষবফ ঃড় বয়ঁধষ ৎরমযঃং ধং ঃড় সধৎৎরধমব, ফঁৎরহম সধৎৎরধমব ধহফ ধঃ রঃং ফরংংড়ষঁঃরড়হ অর্থাৎ দাম্পত্য জীবনের গোটা সময়কাল ধরে এবং তা বিলুপ্তির সময়ে নারী ও পুরুষ সর্বব্যাপারে একসমান অধিকার রাখে। এ বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গিতে তালাকের অধিকারেও নারী এবং পুরুষ দুজনই সমান অধিকার রাখে। অথচ ইসলামে ব্যাপারটা এত সহজ নয়, যতটা সহজ দেখেছেন পশ্চিমা মানবাধিকার বিশেষজ্ঞগণ। কেননা, দাম্পত্য কলহের ক্ষেত্রে নারীরাই সচরাচর দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল হয়। এছাড়া তাদের সাধারণ চাহিদাবলির হাতছানিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদেরকে পুরষদের আগেই তালাক চাইতে অনুপ্রাণিত করে। অথচ তালাকের জন্য যেসব কারণ তারা প্রদর্শন করে থাকে সেগুলোর অধিকাংশই জোরালো কোনো কারণ নয়। ৭/৯/১৯৬৫ তারিখে ইরানের ‘কায়হান’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট এই দাবির সপক্ষে প্রমাণ হিসাবে প্রণিধানযোগ্য। উক্ত রিপোর্টে বলা হয় : ‘১৮৯০ সালে ফ্রান্সে আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল নারীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে।’ তাছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদের পরবর্তী যেসব সমস্যা দেখা দেয়, যেমন শিশুদের যতœ ও লালনপালন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর কাঁধে এসে পড়ে। কিন্তু যদি ঐ শিশুবেলাতেই তাদেরকে শিশুসদন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা মাতৃত্বের মানবীয় আবেগ অনুভব থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে কিশোর ও তরুণ বয়সে তারা মানবীয় ব্যক্তিত্ব ও পরিচয়হীন এক অমানবিক জীবনের ধারায় প্রবাহিত হবে। যাদের সম্পর্কে স্বয়ং পশ্চিমা চিন্তাবিদগণেরই মন্তব্য হচ্ছে, এরা শুধু সেনাবাহিনীর কাজে আসতে পারে সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য, কিন্তু মানবতার কোনো কাজে আসবে না যেখানে মানবীয় গুণাবলি ও মাহাত্ম্য প্রয়োজন।
চার. বিবাহের ক্ষেত্রে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে যুবকরা, যতই উন্নত প্রতিপালন ও শিক্ষা-দীক্ষায় বলীয়ান হোক না কেন, তবুও এ বয়সে তারা জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মর্মার্থ সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি অর্জনে সক্ষম থাকে না। তারা জানে না যে, দায়িত্ব ও কর্তব্যহীন জীবন আর নানান দায়-দায়িত্বভরা জীবনÑ এদুয়ের মধ্যে ঢের পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ অধিকাংশ যুবকের কাছেই বিবাহ বলতে যে বিষয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা হচ্ছে যৌন কামনার নিবারণ। ফলে এ সময়ে বিবাহ পরবর্তী জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তেমন উপলব্ধি তাদের মধ্যে সচরাচর কাজ করে না। আর দৈবাৎ যদি কোনো যুবকের মধ্যে এহেন উপলব্ধির উদ্রেক ঘটেও, তবুও তার যৌবনের তীব্র আকাক্সক্ষার ঢেউ দায়িত্ব ও কর্তব্যের জায়গাগুলোকে ম্লান করে দেয়। ফলে সে সূক্ষ্ম ও সুচারুভাবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারে না। তারপর বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন যৌন আবেগে ভাটা পড়ে, তখন তার মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন স্তর ও মাত্রায় দায়িত্ব ও কর্তব্যের অনুভবগুলো জেগে উঠতে থাকে।
অথচ দুঃখজনকভাবে পাশ্চাত্যজগৎ তার সকল সাংস্কৃতিক ও আইনি অঙ্গনে এ সত্যটির ব্যাপারে ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে থাকে। অথবা কোনো না কোনো কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে জীবনের সকল দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে সরিয়ে রাখে। কিন্তু ইসলাম ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বের সাথে দেখে। একারণে ইসলাম বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যার অভিভাবকের অনুমতিকে একটি শর্ত হিসাবে গণ্য করে থাকে। অর্থাৎ স্ত্রী নির্বাচনের বিষয়টি যেন একতরফাভাবে কোনো যৌন ভাবাবেগে আপ্লুত যুবকের পছন্দের দ্বারাই চূড়ান্ত না হয়। মেয়েদের পক্ষ থেকে পিতা তথা শারয়ী অভিভাবক যেন এ ব্যাপারে যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ায় তৎপর হয় এবং জ্ঞাতসারে অনুমতি প্রদান করে। কেননা, মেয়েদের জন্য সতীত্ব বজায় রাখার আবশ্যকতা সম্পর্কে ইসলামের রক্ষণশীল বিধি-বিধানের কারণে হয়ত তারা ছেলেদের ন্যায় ততটা পরিমাণে বাইরের পৃথিবী ও জীবনাচার সম্পর্কে অবহিত নাও থাকতে পারে। একারণে মেয়েদের পক্ষে তার পিতা কিংবা পিতামহের ন্যায় আপন অভিভাবকের অনুমতি ও সম্মতি লাগে এ ঘাটতি পূরণের জন্য। অবশ্য যখন বিবাহে অনুমতির প্রসঙ্গ আসে তখন উক্ত অনুমতি দাতা অভিভাবককেও যথাযথ যোগ্যতার অধিকারী থাকতে হবে। আর যদি মেয়ের বিবাহে অনুমতি প্রদানের শারয়ী অভিভাবক বলতে কেউ বর্তমান না থাকে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিংবা সমাজের উপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত হয়।
ইসলামে নারী ও পুরুষের অধিকার সম্পর্কে যে পার্থক্য রয়েছে, সে বিষয়ে ইসলাম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ও অবিবেচক ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে অনেক আক্রমণ হানা হয়ে থাকে। তাদের প্রশ্ন একটাইÑ কেন ইসলাম এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করে থাকে? অথচ এ আপত্তির উত্তরে প্রথমইে যেটা বলতে হয় সেটা হলো নারী ও পুরুষের অধিকারে যে পার্থক্য সেটা তাদের দৈহিক, মানসিক এবং পরিবারে তাদের অত্যাবশ্যকীয় অবস্থানের পার্থক্যপ্রসূত, যে পার্থক্য কোনো বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে অস্বীকার করার জো নেই। জ্ঞান-গবেষণা যতই অগ্রসর হচ্ছে, নারী পুরুষের এই পার্থক্যের তালিকা ততই দীর্ঘতর হচ্ছে এবং অদ্যাবধি একশ’রও বেশি পার্থক্যের দিক চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, পশ্চিমা মানবাধিকার সনদে পরিবার সম্পর্কে এবং সামগ্রিকভাবে নারী অধিকার সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তা মূলত কতিপয় নারী স্বাধীনতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। যে স্বাধীনতাগুলোকে কোনোক্রমেই প্রাকৃতিক ও যুক্তিযুক্ত স্বাধীনতা বলা যায় না। কারণ, যদি সেগুলো প্রাকৃতিক ও যুক্তিযুক্তই হতো তাহলে পাশ্চাত্যে এভাবে পরিবারের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ার কথা ছিল না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে ‘সমতা’ (বয়ঁধষরঃু) আর ‘ন্যায়ন্যায্যতা’ (লঁংঃরপব)- এই দুই অভিধাকে একই অর্থে গ্রহণ করা। নারী-পুরুষের সম অধিকার এক জিনিস। আর নারী-পুরুষের ন্যায়ন্যায্য অধিকার অন্য জিনিস। নারী-পুরুষের সমানাধিকারের দাবি তোলার অর্থই হচ্ছে নারী ও পুরুষের দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক পার্থক্যগুলোকে অস্বীকার করা। কেননা, এক্ষেত্রে সমতা ও সমানাধিকারের কথা অবান্তর এবং ভিত্তিহীন। প্রয়োজন হলো ন্যায়ন্যায্যতা, যা নারী ও পুরুষের পার্থক্যগুলোকে মেনে নিয়েই আসে। তাই নারী ও পুরুষের অধিকারের প্রশ্নে পাশ্চাত্য যতদিন ‘সমানাধিকার’ আর ‘ন্যায়ন্যায্য অধিকার’Ñ এদুয়ের মধ্যে পার্থক্যে বিশ্বাস না করবে, ততদিন এতদুভয়ের অধিকার এবং স্বাধীনতার ব্যাপারে তাদের বক্তব্যের সপক্ষে কোনো যুক্তিতর্কই ধোপে টিকবে না।
লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল, ইরানিয়ানি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল