রবিবার, ৭ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

করোনাভাইরাস মহামারিতে নওরোজে ভিন্ন আবহ

পোস্ট হয়েছে: জুন ১৫, ২০২১ 

করোনাভাইরাস মহামারিতে নওরোজে ভিন্ন আবহ
রাশিদুল ইসলাম 

ফারসি ভাষায় নওنو অর্থ নতুন আর রুজ روز অর্থ দিন। বাংলায় আমরা যেমন বছরের প্রথম দিন নববর্ষ উদ্যাপন করি তেমনি ফারসি বছরের প্রথম দিন (২১ মার্চ) ইরান, আফগানিস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এ ফারসি নববর্ষ উদ্যাপন হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এসেছে নওরোজ চলো এ বসন্ত লগনে/ঘর ছেড়ে বাঁধি ঘর সবুজ জঙ্গলে,বনে। কিন্তু এবারো মহামারির কারণে গত বছরের মতো নওরোজে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী। তিনি নওরোজে কোনো সফর করবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গত ফারসি নববর্ষ নওরোজে দেশবাসী করোনা মোকাবেলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা মেনে চলেছেন, এর ফলে বড় দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। এবারও নওরোজে ব্যাপক ঝুঁকি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে করোনা মোকাবেলাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্স যা বলবে তা মেনে চলতে হবে। তারা যদি সফরে যেতে মানা করে তাহলে তা মানতে হবে। আমিও নওরোজে কোনো সফরে যাব না।’ এর আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ফারসি নববর্ষ উপলক্ষে প্রতি বছর মাশহাদে যেতেন, সেখানে ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করতেন এবং সেখান থেকেই নববর্ষের বাণী দিতেন। মাশহাদ হচ্ছে সর্বোচ্চ নেতার জন্মশহর।
নওরোজে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তার দিনে এই মহামারি কালে উৎফুল্লতা হয়ত থাকবে না প্রকাশ্যে কিন্তু ইরানি মুসলমানরা নওরোজের শুরুতেই দুই হাত তুলে পরোয়ারদিগারের কাছে মুনাজাতে বলবেন, ‘হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী (মহান আল্লাহ)! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।’ এ সময় তাঁদের সামনে টেবিলে বা দস্তরখানে থাকে পবিত্র কোরআন, তসবিহ এবং ‘হাফত সিন’ নামে খ্যাত সাতটি বিশেষ সামগ্রীসহ আরো কিছু সামগ্রী।
প্রাচীন ইরানিরা নওরোজকে দু’ভাবে বিভক্ত করে পালন করত। পাঁচদিনব্যাপী পালিত নওরোজ যাতে আপামর জনসাধারণই অংশগ্রহণ করত। বছরের প্রথম দিন পহেলা ফারভারদিন থেকে শুরু হয়ে ৫ ফারভারদিন পর্যন্ত এ উৎসব বিরামহীন চলত। এই পাঁচদিন রাজা-বাদশাহরা জনসাধারণকে বালাখানা বা রাজপ্রাসাদে সাক্ষাৎ দিতেন। তাদেরকে আপ্যায়ন করাতেন। কারাগারের দরজাগুলো খুলে দিয়ে বন্দিদের মুক্তি দিতেন, অভাবী লোকদের অভাব-অনটন দূর করার জন্য চেষ্টা করতেন। মাওলানা রুমীর এক কবিতায় মুক্তির বিষয়টি এসেছে এভাবে- ‘যেহেতু নতুন উৎসবের দিন তাই ফিরে এসেছি কারাগারের তালা ভাঙব বলে, আর এই মানুষখেকো কাল চক্রের থাবা চূর্ণ করব বলে।’
তার মানে নওরোজের মতো উৎসব শুধু বসন্তকালে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া নয়, দ্রোহের সঙ্গে অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ঋজু হয়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয়। ইরান, আফগানিস্তান ছাড়াও আলবেনিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, তুরস্ক, বাংলাদেশ, চীন, জর্জিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইরাক, ইসরায়েল, কাশ্মীর, কাজাখস্তান, কিরঘিস্তান, নর্দান সাইপ্রাস, রাশিয়া, সিরিয়া, তাজিকিস্তান, তুরস্ক, তুর্কমেনিস্তান, ইউক্রেইন, উজবেকিস্তানসহ নানা দেশে নওরোজ আসে প্রতি বছরে উৎসব নিয়ে। উচ্চারণে দেশ ও ভাষা পার্থক্যে নওরোজের উচ্চারণও বদলে যায়। কোথাও নোরুজ, নাওরোউজ, নিউরজ, নভরুজ, নওরোউজ, নাওরোউজ, নাউরিজ, নুরুজ, নাওরুজ, নাভরুজ, নেভরুজ এমননিভাবে উচ্চারিত হতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। আদতে এ উৎসব ইরানি ও জরাথ্রুষ্টরা প্রথম শুরু করে। যা ৩ হাজার বছর আগেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, কৃষ্ণ সাগর উপকূল, বলকান ও দক্ষিণ এশিয়ায় উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

ইরানের হাখামানেশী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস বা কুরুশ বাবেল বা ব্যাবিলন জয়ের বছর তথা খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে সর্বপ্রথম নওরোজকে জাতীয় উৎসব হিসেবে ঘোষণা ও পালন করেন। পারস্য সম্রাট প্রথম দারিউশের শাসনামলে এ উৎসব পার্সেপলিস প্রাসাদ কমপ্লেক্স বা তাখতে জামশিদে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এ উৎসবে উপস্থিত হয়ে ইরান সম্রাটকে নানা উপহার সামগ্রী দিতেন। প্রথম দারিউশ নওরোজ উপলক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৪১৬ সালে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন। আশকানি ও সাসানি সম্রাটদের যুগেও নওরোজ উৎসব পালিত হতো। সাসানি যুগেই নওরোজ উৎসবের অনুষ্ঠানমালা ও পর্বগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি বিস্তৃত হয়েছিল। নওরোজ ইরানি, কুর্দি, তাজিক ও আজেরি জাতিসহ আরো কয়েকটি জাতির বৃহত্তম জাতীয় উৎসব। জাতিসংঘের সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো নওরোজ উৎসবকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইসলাম ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীরাও নওরোজ পালন করে। সেদিক থেকে এ এক ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবও বটে। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক উৎসব হিসেবে একে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। নওরোজ মানে উত্তর গোলার্ধে বসন্তের সূচনা। যে মুহূর্তে সূর্য আকাশের নিরক্ষীয় অঞ্চল অতিক্রম করে এবং রাত ও দিনকে সমান করে প্রতি বছর ঠিক সেই ক্ষণকে গণনা করা হয় আর পরিবারগুলো অনুষ্ঠান পালন করতে একত্রিত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে নওরোজকে ঘিরে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন সময়ে ভিন্ন আঙ্গিকে উৎসবের আয়োজন চলে। যেমন আজারবাইজানে নওরোজের প্রস্তুতি শুরু হয় এক মাস আগে থেকে। নওরোজ উপলক্ষে আজারবাইজানে স্বজনদের গোরস্তানে অনেকে যান দোয়া ও প্রার্থনা করতে। দেশটির মানুষরা পানি, আগুন, মাটি ও বাতাসকে নওরোজের উপকরণ হিসেবে মনে করেন।
আবার অনেকে ইরানি কবিতার সেই ছত্র আবৃত্তি করেন, যেমন ‘আমার দুর্বলতা তোমাকে দিলাম, তোমার শক্তি আমি নিলাম’। (سرخی تو از من‎زردی من از تو، ) উচ্চারণ করলে দাঁড়ায়, ‘জার্দিইয়ে মান আজ তো, শোরখিইয়ে তো আজ মান’। তার মানে নওরোজের উৎসবে মঙ্গল কামনা করে বলা হয় অসুখ-বিসুখ, সংকট যেন অটুট স্বাস্থ্য ও শক্তিমত্তায় রূপান্তরিত হয়। দশম শতাব্দীর পণ্ডিত আল বিরুনি তাঁর বিখ্যাত কিতাব ‘আল-তাফিম লি আওয়াইল সিনাআত আল-তানজিম’-এ বিভিন্ন জাতির নওরোজে অংশগ্রহণের কথা বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। গ্রিক, ইহুদি, আরব, সাবিয়ানসহ বিভিন্ন জাতি নওরোজ উৎসব পালন করত। পারস্য ঐতিহাসিক গারদিজি তাঁর ‘জাইন আল-আখবার’ বইতে জরাথ্রুস্টদের উৎসবপর্বে নওরোজের বিবরণ দিয়েছেন। পার্সেপোলিসেও নওরোজ পালিত হতো শত স্তম্ভের আপাদানা প্রাসাদে। ‘এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’য় দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে ইহুদিরা ইরানি শাসকদের অধীনে এলে উভয় সাংস্কৃতিক উৎসবের একটা অংশ জুড়ে থাকত নওরোজ। এশারবাইতে পুরিমের গল্পে নওরোজের কাহিনী উঠে এসেছে। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব ২৪৮ অব্দ থেকে ২২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে পার্থিয়ান বা আর্সাসিড রাজত্ব ছিল আর্মানিয়া ও ইবেরিয়া জাতির, সেই সময়ে নওরোজ পালিত হতো। এছাড়া ৫১-৭৮ খ্রিস্টাব্দে ভলোগ্যাসের রাজত্বেও পালিত হতো নওরোজ। সাসানি আমলে নওরোজ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে উদ্যাপিত হতো। নগদ উপহার থেকে শুরু করে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া সেকালে যা আরো নওরোজে অনুসরণ করা হয়।
৬৫০ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের পারস্য যুগ শুরু হয়। আব্বাসি শাসনামলে নওরোজ রাজকীয় উৎসবে পরিণত হয়। আবার রাসূল জা’ফারিয়ান তাঁর ‘শিয়া সংস্কৃতিতে নওরোজ’ প্রবন্ধে বলেন, হিজরি ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধ্বে রচিত দোয়া কবুল সংক্রান্ত ‘যাখীরাতুল আখেরা’ গ্রন্থে পারস্যবাসীর নওরোজ দিবসের আমল সম্পর্কে একটি অধ্যায় রয়েছে যার ব্যাখ্যায় মু’আল্লা ইবনে খুনবাইস-এর হাদিসটি এভাবে বলা হয়েছে : হযরত ইমাম (জাফর) সাদেক (আ.) বলেন : ‘নওরোজে তোমরা রোজা রাখ, গোসল কর, সবচেয়ে পরিষ্কার জামা পরিধান কর, খুশবু ব্যবহার কর, যদি পূর্বের নামাজ ও সুন্নাতগুলো আদায় করে থাক, তাহলে দু’টি সালামের সাথে চার রাকাত নামাজ পড়।’
এ হচ্ছে নওরোজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যময় উপলব্ধি। প্রাচীন রীতিনীতি ও পন্থার অনুসরণে এখনো ইরানিরা সেই মূল্যবোধগুলো মেনে চলছেন। তার মানে শুধু সামাজিক রীতিনীতি বা দেশীয় সংস্কৃতিই নয়, নওরোজের সূচনা পর্বে তথা এই দিনের শুরুতে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা হয় এইভাবে- ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি ওয়াল আবসার, ইয়া মুদাব্বিরাল লাইলি ওয়ান্নাহার, ইয়া মুহাভ্ভিলাল হালি ওয়াল আহওয়াল, হাভ্ভিল হালানা ইলা আহসানিল হাল অর্থাৎ হে অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহের বিবর্তনকারী, হে রাত ও দিবসের পরিচালনাকারী, হে বৎসর ও অবস্থাসমূহের পরিবর্তনকারী, আমাদের অবস্থাকে উত্তম অবস্থায় পরিবর্তন করুন।
খিলাফতের পর ইরানি রাজবংশগুলোর উত্থানকালেও নওরোজ আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বোয়াইদ শাসকরা প্রাচীনকালের সাসানিদের রীতি অনুসরণ করতে থাকে। ইরানে বোয়াইদ শাসক আদুদ আল-দাওলা নওরোজ উৎসবে বিশাল প্রাসাদে রাজকীয় স্বাগত জানাতেন অতিথিদের। সোনা ও রুপার প্লেটভর্তি ফল ও রঙ্গিন ফুলের ফুলদানি সাজিয়ে শাসকরা রাজসিংহাসনে বসতেন। রাজকীয় অতিথিরা নওরোজের এ উৎসবে এসে শাসকদের অভিনন্দন জানাতেন। সংগীতশিল্পীরা গেয়ে উঠতেন আর সুরের মূর্ছণা সৃষ্টি হতো- যার মধ্য দিয়ে উৎসব হয়ে উঠত দুর্দান্ত। পরবর্তীতে তুর্কি ও মঙ্গল আগ্রাসনকারীরা নওরোজকে এড়িয়ে গেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে থাকার সময় সেখানে ও ইরান ও আফগানিস্তানে নওরোজ সরকারিভাবে উদ্যাপিত হতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে নওরোজ জাতীয় ছুটির দিনের মর্যাদা পায়। উৎসব শুরু হওয়ার আগে থেকে বাড়ি-ঘর পরিষ্কার, নতুন রংয়ে রাঙ্গিয়ে তোলা, স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, খাবার দাবার ও বস্ত্র কেনাকাটা, দাওয়াত ও নিমন্ত্রণে ভরপুর হয়ে ওঠে নওরোজ। শিশু থেকে শুরু করে মুরুব্বিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় উপহারসামগ্রী।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে শিয়া মুসলিমরা নিয়মিত নওরোজ উৎসব পালন করে। এটি চলে আসছে মোগল শাসনামল থেকে। তখন ১৯ দিনব্যাপী নওরোজ উদ্যাপিত হতো। ঢাকার নবাব পরিবারও নওরোজ উৎসব পালন করে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কবিতায় উঠে এসেছে নওরোজের শাশ্বত বাণী। এসব কবিতায় তরুণদের শৌর্যের সাথে মানসিক সৌন্দর্যের স্বভাবসুলভ আহ্বান ও হৃদয়গাথার পরিচিতি পাওয়া যায়। ভারতের হায়দ্রাবাদসহ বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিমদের মধ্যে নওরোজ উদ্যাপিত হয়ে আসছে মোগল শাসনামল থেকে। কুতুবশাহী আমলেও এ উৎসবের প্রচলন ছিল। সম্রাট হুমায়ূন ভারতের উত্তরাঞ্চলে এই উৎসবটির প্রচলন ঘটান। এরপর স¤্রাট আকবরের রাজত্বের (১৫৫৬-১৬০৫) প্রথম থেকেই নওরোজ উৎসব উদ্যাপিত হতে থাকে। এই উপলক্ষে হেরেমবাসিনী নারীরা শখের বশে দোকান সাজিয়ে মীনা বাজার বসাত।
চীনের উইঘু মুসলমান থেকে শুরু করে তাজিক, সালার ও কাজাখ জাতির মধ্যে নওরোজ উদ্যাপিত হতে দেখা যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া বা ইরাকেও নওরোজের উপস্থিতি রয়েছে। পাকিস্তানের গিলগিট-বালতিস্তান, খাইবার পাখতুনখোয়া বিশেষত দেশটির সঙ্গে আফগান সীমান্ত অঞ্চলের বেলুচিস্তানে নওরোজ উদ্যাপিত হয়ে থাকে। ইসমাইলী সম্প্রদায়েরাও নওরোজে অংশ নিয়ে থাকেন।
শিয়া মুসলিমরা বিশ্বাস করেন তাঁদের সপ্তম ইমাম মূসা আল-কাযিমের বিবৃতি অনুসারে নওরোজের দিন আল্লাহ তাঁর বান্দাদের একমাত্র তাঁরই উপাসনা করার আদেশ দেন, অংশী সাব্যস্ত করতে নিষেধ করেন। তাঁর এ বাণী নিয়ে যখন ফেরেশতা এই দুনিয়ায় আগমন করেন তখন বিশুদ্ধ বায়ু বইতে থাকে এবং ফুলে ফুলে বসন্ত সেজে ওঠে। জিবরাইল (আ.) এদিন নবিজি (সা.)-এর কাছে আসেন। এদিনই ইবরাহিম (আ.) মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। নওরোজেই নবিজি তাঁর কাঁধে হযরত আলীকে তুলে নেন এবং তিনি কাবা শরীফে রক্ষিত মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেন। হযরত আলী এদিনই খিলাফতের দায়িত্ব নেন। শিয়া মুসলমানরা নওরোজে বিশেষ রোজা রাখেন।
নওরোজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আয়োজেন বিশাল বৈচিত্র্যে ভরপুর হওয়ায় এ উৎসবের ব্যাপ্তি অন্য যেকোনো উৎসবের চেয়ে দীর্ঘ দিনের হয়ে থাকে। জ্যোতির্বিদ্যার বিষয়সমূহ নওরোজকে ঘিরে যেন আবর্তিত হতে থাকে। সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন, রাত ও দিনের আবর্তন, বিভিন্ন ঋতুর পরিক্রম, পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের পরিক্রম প্রভৃতি মানুষকে দিনক্ষণ, মাস ও বছরের হিসাব-নিকাশে উদ্বুদ্ধ করেছে, প্রকারান্তরে বাধ্যও করেছে। আর এভাবেই বর্ষপঞ্জির জন্ম দিয়েছে। বছরের শেষ দিনগুলো যেমন অন্তিমের সু তোলে মানবজীবনে এবং কিছুটা হলেও বেদনাকর; তেমনি বছরের শুরুটা মূলত এক নতুনত্বের সূচনা- যা মানুষকে নতুন অনুভূতি, নতুন আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। সূচনা বা শুরু সব সময়ে আনন্দের হয়ে থাকে। এই খুশি ও আনন্দের অভিব্যক্তির জন্য অর্থাৎ তার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটানোর জন্য মানুষ সমাজে বিভিন্ন ধরনের উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করে থাকে। প্রাগৈতিহাসিক কালের ইরানিরা নৈসর্গিক জীবনের সমাপ্তি উপলক্ষে ফারসি সনের শেষ ১১ দিন অর্থাৎ খ্রিস্টীয় হিসাবে ১০ থেকে ২০ মার্চ শোক পালন করত। নওরোজ বা নববর্ষ উপলক্ষে বিশ্বপ্রকৃতিতে নতুন করে জীবনের উপস্থিতিতে এই শোকের সমাপ্তি হতো এবং এ উপলক্ষে আনন্দ উৎসব হতো।
ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ ইরানে বারো মাসে ৪টি ঋতু, যেমন : বাহার (বসন্ত), তাবিস্তান (গ্রীষ্ম), পায়িয (শরৎ) এবং যেমিস্তান (শীতকাল)। এই চার ঋতুর জন্য হাখামানশীদের চারটি ভিন্ন ভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছিল। পার্সেপোলিস ছিল তাদের বাহার বা বসন্তকালীন আবাসস্থল এবং নববর্ষ উদ্যাপনের কেন্দ্র। প্রাচীন ভাস্কর্য ও নকশাসমূহে পরিদৃষ্ট হয় রাজা (সম্রাট) সিংহাসনে বসে তাঁর প্রজাবর্গ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক প্রতিনিধি বা দূতদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন এবং তাঁরাও সম্রাটের জন্য উপঢৌকনাদি অর্পণ করছেন। তার মানে নওরোজ উৎসব ইরানের জাতিগত ঐক্য ও সংহতি গঠনে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে- যার ধারাবাহিকতা আজও বহাল রয়েছে।
কথিত আছে যে, বাদশাহরা এই দিনগুলোতে সিংহাসন ও মুকুট ত্যাগ করতেন এবং জনসাধারণের রায়ের ভিত্তিতে একজন নতুন বাদশাহ নির্বাচন করতেন- যাঁকে বলা হতো মীর-ই-নওরোজী (নওরোজের অধিনায়ক)। এই মনোনীত বাদশাহর শাসন ও আদেশ ৫ দিন পর্যন্ত রাজা-বাদশাহদের আদেশ-নিষেধের ন্যায়ই কার্যকর হতো। তবে এটা ছিল এক প্রতীকী কর্তৃত্বস্বরূপ।
ড. মাহমুদ বাশীরীর মতে, এই প্রাচীন নিয়ম অনুসরণে এখনও কুর্দিস্তান প্রদেশসহ আরও কোনো কোনো প্রদেশ ও অঞ্চলে এ প্রথাটি চালু রয়েছে। এই প্রথাটির সত্যতা কবি হাফিজের কবিতায়ও পাওয়া যায়। হাফিজ বলেন : ‘শোনো, অন্তরলোক থেকে বলছি ফুলের মতো কলি ছেড়ে বেরিয়ে এসো, কারণ, পাঁচদিনের বেশি চলবে না মীরে নওরোজীর ফরমান।’
এই পাঁচদিনকে ইরানি লোকজন ‘নওরোজে সাগীর’বলে থাকে- যার অর্থ হচ্ছে ছোট নওরোজ। এই নামটি বর্তমানে প্রচলিত নেই। তবে সে অতীতকালের অনেক নিয়ম এখনও বিদ্যমান। বর্তমানকালেও সমগ্র ইরানব্যাপী ফারভারদিন মাসের প্রথম পাঁচদিন সাধারণ ছুটি রয়েছে এবং তাঁরা অতীতের মতোই উৎসব আনন্দে মেতে থাকেন। এরপর একটি বিশেষ শ্রেণি ফারভারদিন মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে থাকে। ইরানিরা এই ১৩ তারিখটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং একে বলেন ‘সিযদা বেদার’। ফারসি ভাষায় ‘সিযদাহ মানে তেরো। আর ‘বেদার’ অর্থ ঘরছাড়া। এই দিন ঘরে থাকা তাঁদের জন্য দূষণীয়। সবাই পার্ক, মাঠ-ময়দান বা অনুরূপ বিশেষ স্থানে বেড়াতে যান এবং সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে আসেন। এ দিনটি সর্বজনীন ছুটির দিন।
প্রাচীন ইরানি জাতির বিশ্বাস পহেলা ফারভারদিন আল্লাহ বিশ্বলোক সৃষ্টি করেছেন। এ ছাড়া প্রজ্ঞার প্রতীক সাতটি নক্ষত্রও এইদিন সৃষ্টি হয়েছিল বলে তাঁদের বিশ্বাস- যা ইরানের প্রাচীন মনীষী বা জ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সাত আসমানি পিতা নামে অভিহিত। পানি, মৃত্তিকা, অগ্নি ও বাতাস- এই চারটি উপাদানের ওপর উক্ত সাতটি নক্ষত্রের প্রভাবের কারণে যে তিনটি বস্তু সৃষ্টি হয় তা হচ্ছে জড় পদার্থ, বৃক্ষ ও প্রাণীকুল, আর এই চারটিকে বলে ‘উম্মাহাতে আরবা’ বা চার জননী। প্রাচীন ইরানিদের বিশ্বাস মতে প্রথম মানব আদমও বসন্তের এই প্রথম দিনে সৃষ্ট। হাফেজ শিরাজীর একটি গযল যা‘বার-ই-আমানাত’ (আমানাতের বোঝা) নামে খ্যাত, তা এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট।
এখনো অতীতের আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করে নওরোজ উপলক্ষে বিশেষ ধরনের দরস্তরখান বিছানো হয় এবং তার ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী সাতটি উপকরণ যেগুলোর নাম ফারসি বর্ণমালার ‘সীন’ (সাত সীন) নামে বিখ্যাত। হাফ্ত সীন্ সাধারণত এমন হয়ে থাকে। এগুলোহচ্ছে :
সাবযেহ (সবুজাভ) : গম বা ডালের কচি চারার গুচ্ছ যা নওরোজের অব্যবহিত পূর্বে গজিয়েছে একটা ট্রে বা প্লেটের ওপর বসিয়ে হাফ্ত সীন্ দস্তরখানায় রাখা হয় যা নব জীবনের প্রতীক।
সামানু : কচি গম, বার্লি বা অন্যান্য শস্যদানার আটা দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের হালুয়া যা প্রাচুর্য ও নেয়ামতের প্রতীক।
সেনজাদ : একপ্রকার শুষ্ক ফল যা ভালোবাসা ও প্রেমের প্রতীক।
সীর (রসুন) : সৌন্দর্য ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক।
সোম্মাগ : মসুরের ডালের চেয়ে সামান্য বড় লাল রঙের টক ফলবিশেষ যা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক।
সিরকা : দীর্ঘায়ু ও ধৈর্যের প্রতীক।
সোমবোল : ছোট আকারের ফুল ও উদ্ভিদবিশেষ যা বসন্তের আগমনবার্তা বহন করে নিয়ে আসে।
সেক্কেহ্ (কয়েন বা মুদ্রা) : সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক।
ইরানে বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ ও সংস্কৃতির উদ্ভব ও মিলন ঘটে যা অন্য কোন দেশে পাওয়া দুষ্কর। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এবং সুপ্রাচীনকালে ইরানিদের ধর্মবিশ্বাস ও জাতিসত্তার বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রান্ত হয়। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে এক খোদার ইবাদত এবং র্শ্কি ও বহু দেব-দেবীর পূজা প্রতিহতকরণ। জরাথ্রুস্টীয় ধর্ম এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। জরাথ্রুস্টীয় ধর্মমতে আহুরমায্দার প্রতি বিশ্বাস পোষণ করা হয় যাতে তাওহীদে বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে।
ইসলামের আবির্ভাব বিশেষত ইরানিদের ধর্ম ও জাতীয় ধ্যান-ধারণার সাথে ইসলামের শান্তিবাদী আচরণের কারণে ইরানিদের ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তাঁদের আগেকার কতক ধ্যান-ধারণা ও রসম-রেওয়াজ অব্যাহত থাকে। অবশ্য ইরানবিজেতা আরব মুসলমানদের ইরানিদের সাথে সদয় আচরণের কারণে তাঁরা ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে বরণ করে নেন এবং তাঁদের আদর্শ ব্যক্তিবর্গ, বীরপুরুষ ও প্রাচীন কাহিনীগুলোকে ইসলামের রঙে রঙিন করে নেন।
প্রাচীন ইরানিদের কিছু কিছু উপলক্ষ ও রেওয়াজ তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও জনগণের ধ্যান-ধারণার সাথে মিশে গিয়েছিল। নওরোজ এর অন্যতম। সুদীর্ঘ কয়েক সহস্রাব্দের পুরনো এ ঐতিহ্যটি ইরানের মুসলমানদের মনে একটা স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছে। এখনও ইরানের অধিকাংশ লোকই পুরাতন বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমনক্ষণে নতুন পোশাক পরিধান করে মিষ্টিমধুর আচরণসহকারে পবিত্র স্থানে বা পরিবারের মুরুব্বিদের সাথে কাটাতে পছন্দ করেন। সে মুহূর্তে তাঁরা কুরআন তেলাওয়াত করে ও দু’হাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে নিজেদের ও পরিবারবর্গের জন্য একটি সুন্দর এবং সুস্থতা ও সমৃদ্ধিপূর্ণ বছর কামনা করেন। নওরোজে পরস্পরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়, কারও প্রতি রাগ বা ক্ষোভ থাকলে পরস্পরকে ক্ষমা করে দেয়া এবং নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা আরেক রীতি। এছাড়া এ দিনে তাঁরা এমন সব ব্যক্তির সাথে দেখা করতে যান যাঁরা পুরাতন বছরে কোন প্রিয়জনকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমাণ হয়ে আছেন। এভাবে নওরোজ প্রাচীন ইরান থেকে পর্যায়ক্রমে বর্তমান রূপে এসে দাঁড়িয়েছে এবং ইসলামের পছন্দনীয় রীতি-নীতিগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই ইসলামের মূলনীতির সাথে এর কোন বিরোধ নেই; বরং নওরোজ উৎসব ইরানি সমাজের জন্য নৈতিক ও সামগ্রিক শিক্ষার সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।