রবিবার, ৭ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরান পরিচিতি : নিশাপুর

পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ১০, ২০১৬ 

-কামাল মাহমুদ
ইরানের অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুর। রাজাভী খোরাসান প্রদেশে এর অবস্থান। খ্রিস্টিয় ৩য় শতকে প্রথম শা’পুর এ শহরের গোড়াপত্তন করেন, যা ১৯৩১ সালে মিউনিসিপ্যালিটিতে রূপান্তরিত হয়। ২০১১ সালের হিসাব অনুসারে এ শহরের লোকসংখ্যা ২৭০৩০১ জন। নিশাপুরকে স্থানীয়ভাবে নিশাবুর বা নেইশাবুর নামে উচ্চারণ করা হয়। নিশাপুর নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও নিউশা’পুর বা নিউ সিটি অব শা’পুর বা শা’পুরের নতুন শহর এ নামকরণটিই সমধিক প্রসিদ্ধ। এটি প্রাচীন খোরাসানের রাজধানী। কয়েকটি সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই নিশাপুর। দক্ষিণ ইরানে এর অবস্থান।
প্রথম শা’পুর একে সাসানী সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে তাহেরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবেও এটি পরিগণিত হয়। ৮৩০ সালে আবদুল্লাহ তাহির এর সংস্কার করেন। ১০৩৭ সালে সালজুক সা¤্রাজ্যকালেও এটি রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। আব্বাসী আমলে নিশাপুর সংস্কৃতি, বাণিজ্য এবং ইসলামী বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য শহর হিসেবে পরিগণিত হয়। নাসের খসরুর সফরনামাসহ প্রাচীন অনেক গ্রন্থে নিশাপুরের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চমৎকার বর্ণনা রয়েছে। টেক্সাস, চীন, ইরাক ও মিশরের সাথে ইরানের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় নিশাপুর। ইরানের ব্যবসায়িক রুট হিসেবে নিশাপুরের গুরুত্ব অপরীসীম।
দশম শতাব্দীতে সামানী সা¤্রাজ্যকালে নিশাপুরের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। কিন্তু ১২১১ সালে মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে নিশাপুর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নিশাপুরে ‘মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এটি সাজানো হয়; কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এ মিউজিয়াম লুটতরজের শিকার হয় এবং দর্শনীয় সামগ্রী লণ্ডভণ্ড করা হয়। এ মিউজিয়ামটি প্রাক-ইসলামী যুগের নিদর্শনের জন্য আজো বিশ্বখ্যাত। সা’দ ইয়াখ (প্রশান্তির প্রাসাদ) নবম শতাব্দীতে প্রাচীন নিদর্শনাবলির অন্যতম। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
সিল্ক রোডের কারণে নিশাপুর যাতায়াতের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কানেক্টিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আনাতোলিয়া থেকে চীন পর্যন্ত সিল্ক রোড সংযোগ স্থাপন করেছে। নিশাপুর ইরানের মালভূমি ও মধ্য এশিয়ার সীমানাবর্তী এলাকা হিসেবেও আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাস ট্রেন উভয় পথেই নিশাপুরে যাতায়াত করা যায়। সড়কপথে ৪৪টি হাইওয়ে রয়েছে যা তেহরান, মাশহাদসহ ইরানের বিভিন্ন শহরের সাথে সংযুক্ত। পর্যটনের জন্য রয়েছে নানা মনোরম দর্শনীয় স্থান।
চেঙ্গিস খানের জামাতা ১২১১ সালে নিশাপুরে নিহত হন এবং চেঙ্গিস খান নিশাপুরের সবাইকে হত্যার নির্দেশ দেন। নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ, শিশু-কিশোরদের লাশ দিয়ে মোঙ্গলরা নিশাপুরে পিরামিড তৈরি করেছিল।
২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে নিশাপুরে স্বতন্ত্র্য জাতীয় সংগীত চালু করা হয়। নিশাপুরে স্থানীয়ভাবে অনেকগুলো দিবস পালিত হয়ে থাকে। যথা : ১৩ ফারাভারদিন- প্রকৃতি দিবস, ২৫ ফারাভারদিন- আত্তার দিবস, ২৮ উর্দিবেহেশত- খৈয়াম দিবস, ১০ তির- ইমাম আলী রেযা (আ.) দিবস, ২ মোরদাদ- রাজান বন্যা স্মরণ দিবস, ৩০ অযার- ইয়ালদা রাত, ২৯ বাহমান- নিশাপুর ট্রেন দুর্ঘটনা দিবস, ২৫ রজব- মূসা আল কাযিম (আ.)-এর শাহাদাত দিবস প্রভৃতি।
সালজুক আমলে শিল্পের দিক থেকে নিশাপুর বাগদাদ, কায়রো ও তুঘরিলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত হতো। ১০৩৭ সালে এখানে অনেক বসতি ছিল। সে সময়ে নিশাপুর পৃথিবীর দশটি সমৃদ্ধ নগরীর অন্যতম হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিল। ইসলামী স্বর্ণযুগে বিশেষত নবম ও দশম শতাব্দীতে মৃৎশিল্প সহ অন্যান্য শিল্পের অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল নিশাপুর। অধিকাংশ সিরামিক দ্রব্য নিশাপুরেই তৈরি হতো- যার নিদর্শন তেহরান, মাশহাদ ও নিশাপুরের মিউজিয়ামে কিয়দংশ সংরক্ষিত আছে। বর্তমানে নিশাপুরে চারটি মৃৎশিল্প কারখানা রয়েছে। নিশাপুরের প্রায় ৪৭০টি গ্রামে কার্পেট বোনা হয়। তন্মধ্যে শাফী আবাদ, গারীনে দারুদ, বোযগান, সৈয়দাবাদ, সারচাহ, সুলতান আবাদ প্রভৃতি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিশ্বের বৃহৎ আকৃতির কার্পেটের অনেকগুলোই নিশাপুরের তৈরী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শেখ যায়েদ মসজিদ, সুলতান কাবুস মসজিদ, আর্মেনিয়ার রাজপ্রাসাদ, তেহরানস্থ ফিনল্যান্ড এম্বেসী, ওমানের আল আমিন মসজিদ সহ বিভিন্ন বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিশাপুরের বৃহৎ কার্পেট ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
নিশাপুরে বেশ কতগুলো শিল্পকারখানা রয়েছে। এখানে রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। কৃষিক্ষেত্রে নিশাপুরের অবদান উল্লেখ করার মতো। নিশাপুরের তুলার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। যার বেশিরভাগ কার্পেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
নিশাপুরের সিরামিক আজো বিশ্বখ্যাত; বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। এখানকার অন্যতম শিল্প হলো টাইল্স ও মোজাইক। এখানে প্রাচীনকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভবনের গায়ে নানা রংয়ের টাইল্স খোদাই করা হয়ে থাকে। বিশেষত নীল রংয়ের টাইল্স; কেননা, এই রঙ-কে ‘কালার অব হ্যাভেন’ বা ‘স্বর্গীয় রঙ’ মনে করা হয়ে থাকে। কাঠ খোদাই, হাতে বোনা কাপড়, পশমি কাপড়, পেইন্টিং, ক্যালিগ্রাফি, ভাস্কর্য, দেয়াল পেইন্টিং প্রভৃতিতে নিশাপুরের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন।
নিশাপুরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আরবি ও ফারসি প্রচলিত রয়েছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির প্রচলন রয়েছে। তবে নিশাপুরের অধিকাংশ লোক ফারসি ভাষায় কথা বলে। অধিকাংশই ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং বারো ইমামী শিয়া মাযহাবে বিশ্বাসী। উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটির মূল শাখা- যার অনেকগুলো শাখা ইরানের বিভিন্ন প্রদেশে রয়েছে।
নিশাপুরের বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে আবু সাঈদ আবুল খায়ের, ওমর খৈয়াম, ফরিদ উদ্দিন আত্তার, সা’দাত আলী খান, হোসেন ওয়ালীদ খোরাসানী, যারতুশতীয়ান ধর্মমতের প্রবক্তা মাযদাক, ইসহাক ইবনে রাওয়াহ, ইবনে খুজামা, মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ, আল জুয়াইনী, সালিম নিশাপুরী, মুহাম্মাদ রেযা শাফেয়ী কাদকানী, আবুল হাসান দাউদী, হোসাইন সায়েদী প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
খেলাধুলায় নিশাপুর বেশ অগ্রসর। এখানকার পেশাদার ফুটবল দলের নাম হচ্ছে ‘জাহান ইলেট্রিক নিশাপুর’। ইনডোর খেলাধুলার জন্য ‘ইনকিলাব স্পোর্টস কমপ্লেক্স’- যেখানে বাস্কেটবল, ভলিবলসহ নানা প্রকার ইনডোর খেলার ব্যবস্থা রয়েছে।
ভৌগোলিক দিক দিয়ে ১২১৩ স্কয়ার মিটার উর্বর সমভূমি রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে রয়েছে মাউন্ট বিনালুদ। নিশাপুরের আবহাওয়া ভূমধ্যসাগরীয়। বসন্ত ও শীত এখানকার দৃশ্যমান প্রধান ঋতু। মাঝে মধ্যে বৃষ্টিপাতও হয়ে থাকে। নিশাপুর ভূকম্পনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভূকম্পনে নিশাপুর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে বোজন গ্রামে বন্যায় ১০০০ লোক নিহত ও বহু লোক আহতসহ নানা প্রকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
নিশাপুরে মাসিক ও সাপ্তাহিক অনেকগুলো পত্রিকা প্রকাশিত হয়। খোরাসান অঞ্চলের প্রথম পত্রিকা ‘মর্নিং অব নিশাপুর’ ১৯৮৯ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। অন্যান্য পত্রিকার মধ্যে ২০০২ সাল থেকে ‘সাদিকেহ’, ২০০৪ সাল থেকে খৈয়াম, ২০০৬ সাল থেকে নাসিম, ২০১০ সাল থেকে সী র্মোগ প্রভৃতি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে।
পৃথিবীর প্রাচীন নগরীগুলোর অন্যতম নিশাপুর প্রাকৃতিক নৈসর্গে ভরা এক ভূমি। নিশাপুরে জন্ম নিয়েছেন সেসব বিখ্যাত মানুষ যাঁরা জগৎমাঝে চিরস্মরণীয় থাকবেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কবি, সাহিত্যক, দার্শনিক, চিকিৎসক, ধর্মবেত্তা, ধর্মমতের প্রবক্তা প্রমুখ। ফারসি কবিতার শিরোমনি আত্তার, খৈয়াম, আবু সাঈদ আবুল খায়ের শাফেয়ী কাদকানীসহ অনেক কবি এ নিশাপুরের সন্তান। নিশাপুর ইরানের অন্যতম সংস্কৃতি নগরী হিসেবে খ্যাত। ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে নিশাপুর অনন্য নাম। নান উত্থান-পতন আর ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে নিশাপুর আজো পৃথিবীর বিখ্যাত নগরী হিসেবে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে।