রবিবার, ৭ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইমামের স্মরণে- ইমামের পথে

পোস্ট হয়েছে: ডিসেম্বর ২৬, ২০১৩ 

news-image
হুশাং আলী মাদাদী

১৯৮৯ সালের ৩রা জুন ইসলামী বিপ্লবের স্থপতি ইমাম খোমেইনী (রহ.) বিশ্বের নির্যাতিত জাতিগুলোকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন।

দুটি বছর চলে গেল… হ্যাঁ, এমন দুটি বছর অতিক্রান্ত হলো যার প্রতিটি দিন ছিল ব্যথা-বেদনায় ভরা। দুঃখ, অনুতাপ, শোক ও মাতমে আকীর্ণ। অশ্রু আর আর্তনাদ ছিল- ছিল অশ্রু আর অশ্রুই…

এখনো আমাদের বিশ্বাস হয় না যে, হযরত ইমাম আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন, আমাদের ইয়াতীম করে ফেলে গেছেন-

দুটি বছর এভাবেই কেটে গেল। আমরা বিশ্বাস করতে পারি না যে, ঈমান, ভালোবাসা, সাধনা ও ইরফানের প্রতিচ্ছবি ও বিপ্লবের মহান নেতার হৃদয়বিদারক ইন্তেকাল ঘটেছে।

দুটি বছর পার হয়ে গেল…

আধ্যাত্মিক অথৈ সাগরের কাণ্ডারি আর মারেফাতের মুর্শিদের ইন্তেকালের পর দুটি বছর পার হলো। এই দুটি বছরের প্রতিটি দিনই ছিল হাজারো দিনের সমান। যেদিন ইমামে উম্মত ইসলামী দেশ ইরানে পদার্পণ করেন, সেদিন জনতার বিশাল তরঙ্গমালা তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছিল প্রাণের আকুতি দিয়ে। যেদিকেই দৃষ্টি যেত শুধু লোক আর লোক। জনতার অথৈ সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পড়েছিল কূলভাঙ্গা জোয়ারে। তাদের নেতা ও ইমাম ফিরে এসেছেন, তাই আনন্দের এত জোয়ার। বসন্তের ছোঁয়ায় আশার বাগানের একমাত্র কিশলয়টি পল্লবিত হাওয়ায় সেদিন আন্দোলিত সুরভিত হয়েছিল বিপ্লবী চেনতায় স্পন্দিত জনতার গোলাপ কানন। তাই তাদের আনন্দের জোয়ার ছিল স্বাভাবিক ও স্বতঃ¯ফূর্ত। আনন্দে বুক ফেটে বেরিয়ে আসছিল স্লোগানের পর স্লোগান…

সেই ঐতিহাসিক দিনে, সেই সমারোহের দিবসে আশার ফল্গুধারায়, বসন্তের সমীরণে বাগানের নতুন সাজের দিনে সবার পরনে ছিল সফেদ পোশাক। তাদের চেহারায় ছিল জগতের সকল আনন্দ, উদ্দীপনা আর খুশির সমারোহ…

তারপর… তারপর দশটি বছর অতিক্রান্ত হবার পর আজ থেকে দুবছর পূর্বে আমাদের ঘর-বাহিরে শহর-পল্লির সর্বত্র আবার জনতার ঢল নেমেছিল। কিন্তু এ ঢল আনন্দের নয়, ছিল অশ্রুর। শোক ও মাতমে মূর্ছা প্রায়, কালো পোশাকে আচ্ছাদিত, বক্ষে ও ললাটে আঘাতরত ব্যথিতপ্রাণ মানুষের ঢল। বেদনায় ভারাক্রান্ত ও বিপন্ন মানুষেরা সেদিন হয়েছিল নিথর, বাকহারা। কান্নার জন্য ছিল না তাদের নয়নে অশ্রুবারি। ইমামকে চিরবিদায় দেয়ার অনুষ্ঠানে, ইমামের জানাযায় শরীক কোটি মানুষের এ ছিল অবস্থা…

হ্যাঁ, ইমামের দেহ আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছে। কিন্তু তাঁর চিন্তা-দর্শন ও দিক-নির্দেশনা চিরন্তন হয়ে রয়েছে। তাই প্রিয় ইমামের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বেদনাতুর হৃদয়ের সমুদ্রসম বিরহগাথার কয়েকটি কথা আপনাদের জন্য ব্যক্ত করতে চাই।

৯১ বছর আগে জমাদিউস সানীর ২০ তারিখে, রাসূলে পাকের প্রাণপ্রিয় কন্যা আমাদের মা সিদ্দিকা কুবরা হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জন্মদিনে তাঁরই বংশের এক সন্তান জন্মগ্রহণ করেন ইরানের খোমেইন শহরে। এই নবজাতকই প্রদীপ্ত চন্দ্র আর সমুজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো নবী বংশের (আহলে বাইতের) নিষ্পাপ ইমামগণের উত্তরসূরিরূপে উদ্ভাসিত হন। আর এটাও ছিল হযরত ফাতেমা (আ.)-এর বরকত ও মাহাত্ম্যের আশীর্বাদস্বরূপ। শত শত সালাম ও দরূদ আরজ করছি তাঁর প্রতি। ১৩২০ হিজরির যে দিনটিতে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জন্মদিবস উদযাপিত হচ্ছিল সেদিনই এমন এক সন্তানের জন্ম হয়, যে সন্তান তাঁর সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের জটিল ও ভয়াবহ আবর্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং দুশমনদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেন।

হ্যাঁ, ১৩৩৮ বছর পর সেই দিনটিতে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর বংশধারায় এমন শিশুর আগমন হলো, পরবর্তীকালে যিনি হলেন ইতিহাসের ব্যতিক্রম, দ্বীনের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, যুগের দেদীপ্যমান সূর্য, স্বাধীন মানুষের সিপাহসালার ও তরিকতের পথিকদের মুর্শিদ। রুহুল্লাহ ঐ দিনই মায়ের কোল উদ্ভাসিত করেন। তাঁর জন্মের মধ্য দিয়ে নতুন এক ইতিহাসের সূচনা হয়।

রুহুল্লাহ কে?

রুহুল্লাহ সেই মহান আরেফ, যাঁর ইরফান ও আধ্যাত্মিকতার সুরাহী  থেকে প্রেমের সুধা পান করে তৃপ্তিলাভের জন্য আরেফ ও প্রেমিকগণ আকুল। রুহুল্লাহ সেই মহাপুরুষ যাঁর অস্তিত্বের ছায়াতলে দুনিয়ার চিন্তাবিদ ও মনীষীরা আশ্রয় চান আর তাঁর মাহাত্ম্য ও জ্ঞানগরিমার অসীম সমুদ্র থেকে এক অঞ্জলি পানি পান করার জন্য অধীর হয়ে থাকেন।

রুহুল্লাহ সেই মহান ব্যক্তিত্ব যাঁর প্রশংসা ও গুণগরিমা বর্ণনায় যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীরাও ক্লান্ত; যাঁর সম্মান ও মর্যাদার খ্যাতি আকাশের দিগন্ত ছাড়িয়ে গেছে, মানুষের মন ও সমাজে আশীর্বাদের বৃষ্টির মতো বর্ষিত হয়েছে এবং মানব মুক্তির চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রকে ফুল ও ফলে সজ্জিত করেছে।

রুহুল্লাহ সেই মূর্তিনাশী, যিনি ইবরাহীম (আ.)-এর আদর্শ অনুসরণে অজ্ঞতা, শক্তিমদত্ততা, শোষণ ও উপনিবেশবাদের মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন এবং খোদাপ্রেমের পথে ইসমাঈলদের (বিপ্লবের মহান শহীদদের) কোরবানি করেছেন। যিনি কালেমাতুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর বাণীকে মহীয়ান আর আল্লাহর দুশমনদের বাণীকে পদানত করেছেন।

রুহুল্লাহ সেই মহান নিশানবরদার যিনি আপন পূর্বপুরুষদের ন্যায় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ঝাণ্ডা কাঁধে নিয়ে খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের আওয়াজকে সারা বিশ্বে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করেছেন। যিনি শতাব্দীকাল ধরে অপমানিত, লাঞ্ছিত ও নিপতিত মুসলমানদের হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছেন আর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জাহেলিয়াতের পর্দা ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছেন। যিনি ক্ষুরধার তরবারি, ¯পষ্ট ভাষণ, বলিষ্ঠ লেখনি ও সংগ্রাম সাধনার মাধ্যমে স্বীয় পূর্বপুরুষ মহানবী (সা.)-এর দ্বীনের সীমান্তকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত রক্ষা করেছেন। যিনি বিস্তীর্ণ, কণ্টকাকীর্ণ গোমরাহির অমানিশার মধ্যে ইসলামের সত্যিকার পথকে চিহ্নিত করে মুসলমানদের চিন্তার ভূমিতে খাঁটি ইসলামের পবিত্র বৃক্ষের চারা রোপন করেছেন। যদিও এ পথে তিনি অনেক আঘাত সহ্য করেছেন, অনেক হৃদয়ের রক্ত ঝরতে দেখেছেন এবং বুজুর্গের বেশধারী আহমকদের পক্ষ থেকে আরোপিত অনেক অপবাদ ও দুর্নাম সহ্য করেছেন। কিন্তু সবকিছুকে তিনি অম্লান বদনে একমাত্র আল্লাহর জন্য সহ্য করেছেন; তিনি খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের দিকে তাক করা যে কোন বিষাক্ত তীরকে বুক পেতে নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি দুর্নাম আর গুজবকে মোটেও ভয় করেননি; বরং অত্যন্ত দৃঢ় ও অবিচলচিত্তে প্রেমের পথে এগিয়ে গেছেন, অবিচল পর্বতের ন্যায় যুগের সকল ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করেছেন এবং মুহূর্তের জন্যও সংকুচিত হননি। যদিও তিনি হীন চরিত্রের ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাত থেকে সমসাময়িক সকল দায়িত্বপরায়ণ লোকের চাইতে অধিক দুঃখ কষ্ট ও আঘাতের সম্মুখীন হয়েছেন; কিন্তু এ বৈশিষ্ট্য তিনি তাঁর পূর্বপুরুষ রাসূলে পাক (সা.)-এর কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন, যিনি বলেছেন, ‘আমাকে যেরূপ কষ্ট দেয়া হয়েছে, সেরূপ কষ্ট আর কোন নবীকেই দেয়া হয়নি।

রুহুল্লাহ সম্মান ও মর্যাদার উচ্চ শৃঙ্গ, দুনিয়ার বঞ্চিত, নির্যাতিত (মুস্তাজয়াফ) মানুষের আশার প্রদীপ। তিনি সেই সুন্দর মানুষ, যিনি ইবাদত-বন্দেগি, সাধনা ও পবিত্রতা, তাকওয়া-পরহেজগারি, খোদাভীতি, ন্যায়নিষ্ঠা, বিনয় ও নম্রতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে শুধু সমসাময়িক যুগেই নয়, নিষ্পাপ ইমামদের পর প্রায় সকল যুগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন।

রুহুল্লাহ জ্ঞান ও দূরদর্শিতার প্রতিচ্ছবি, জিহাদ ও শাহাদাতের ময়দানের বীর সেনানী, দুনিয়ার বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষ ও মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা, হতাশাগ্রস্ত অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল। যিনি যুলুমবাজ, শোষকশ্রেণি, অর্থগৃধনু, ক্ষমতাদর্পী, ছদ্মবেশী আলেম, সাম্রাজ্যবাদের দোসর এবং তাদের সব রকমের অনুসারীর বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্তে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করেছেন এবং ওহী ও রেসালতের পথ ধরে আসা আমানতকে যুলুম ও অজ্ঞতা পরিহার করে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে বহন করেছেন।

হ্যাঁ, ইমাম তাঁর পার্থিব জীবনের অল্প সময়ে আল্লাহর প্রতি তাঁর দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছেন। তিনি তাঁর বরকতময় জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য সাধ্যমত সর্বোত্তম পন্থায় খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনিই নির্ভীকচিত্তে দুনিয়ার সমস্ত শক্তিমদমত্ত বিশ্বগ্রাসীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির দম্ভ ও ভাবমূর্তি চূর্ণ করেছেন।

তিনিই ইসলামী বিপ্লবের ভিত্তি মূলকে সুদৃঢ়  করেছেন এবং এ বিপ্লবকে দুশমনদের সব রকমের চক্রান্ত ও নীলনকশা থেকে রক্ষা করেছেন।

তিনিই ছিলেন সেই অসীম সাহসী পুরুষ, যিনি মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে ভয় করেননি এবং ভর্ৎসনাকারীদের তিরস্কার তাঁকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি পশ্চিমা পুঁজিবাদের ফেতনা ও অপকীর্তি এবং প্রাচ্য কম্যুনিজমের আগ্রাসন ও অন্তঃসারশূন্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও লড়াই থেকে মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকেননি। প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্য নয়স্লোগানকে তিনি ইসলামী বিপ্লবের এক অপরিবর্তনশীল স্লোগানে পরিণত করেছেন এবং এর বরখেলাপ করা অমার্জনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বস্তুত আল্লাহর সেই মহান বান্দা বঞ্চিত নির্যাতিত মানুষের বন্ধু, যালিমদের ত্রাস, আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী, আল্লাহ ও রাসূলের দুশমনদের মৃত্যুদ- দানকারী ব্যক্তিত্ব ইমাম রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল- খোমেইনী ছাড়া আর কে হতে পারেন?

মূলত তিনি একজন ব্যক্তিই ছিলেন না; বরং একাই ছিলেন এক বিরাট জাতি, বীরত্ব, সাহসিকতা, ধৈর্য, অল্পে তুষ্টি, পুতপবিত্রতা এবং সর্বোপরি বঞ্চিত নির্যাতিত মানুষের প্রতি দায়িত্ব সচেতনতা প্রভৃতি মানবীয় গুণের সমষ্টি। এজন্য তিনি কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর অনুরক্ত ও প্রেমিকদের হৃদয় জগতে অমর হয়ে থাকবেন। আর আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো- যদি আমরা দুনিয়া ও আখেরাতের সম্মান ও মর্যাদার আকাঙ্ক্ষী হই, তাহলে আল্লাহর প্রেমিকদের এই কাফেলা থেকে যেন কেউ পেছনে পড়ে না থাকি।

আসুন, আজ আমরা এই মহান ব্যক্তিত্বকে হারানোর বার্ষিকীতে ইসলামী বিপ্লবের নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ও দুনিয়ার সকল মুসলমানের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাই।

মহান ইমাম দৈহিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, তবু তাঁর চিন্তাধারা ও উপদেশবাণী আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। আমাদের একান্ত কামনা আল্লাহ পাক আমাদেরকে সাহায্য করবেন, যাতে তাঁর বরকতময় জীবনের বৈশিষ্ট্যাবলি অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে পারি, ইনশাআল্লাহ…।

 (নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)