রবিবার, ৭ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইধির সঙ্গে দেখা, জীবনের প্রতিটি দিনই ছিল যার সেরা

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ১০, ২০১৬ 

রাশিদুল ইসলাম

পাকিস্তানের সবচেয়ে ধনী ও একই সঙ্গে গরীব ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত তিনি। আবার গরীব দুঃখীদের সেবায় যার তার দানকে তিনি গ্রহণ করেন নি। যাঁরা তাঁকে দিয়েছেন তা ইধি অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন অন্যের প্রয়োজেন। ভারত থেকে হিজরত করে পাকিস্তানে যান গরীবদরদি আবদুল সাত্তার ইধি। গত ৮ জুলাই, ২০১৬, শুক্রবার রাতে চলে গেলেন তিনি না ফেরার দেশে। ১৯২৮ সালের পয়লা জানুয়ারি ইধি ভারতে জন্মগ্রহণ করেন।
গত কয়েক বছর ধরেই তিনি কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফ সরকার চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে পাঠানোরও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সবিনয়ে সেই প্রস্তাব বরাবরের মতই ফিরিয়ে দেন আবদুল সাত্তার ইধি। নিজের দেশের সরকারি হাসপাতালে থেকেই চিকিৎসা করাতে চান তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই ফেরেশতাতুল্য এই মানুষটি ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য। ভারতের মাদার টেরেজার সঙ্গেও বারবার তুলনা হয়েছে ছোটখাটো চেহারার এই মানুষটির। কিন্তু ইধির কর্মপরিধি মাদার তেরেজার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। বিশেষত তাঁর সাহায্যসেবা কার্যক্রমের বিরাট অংশ ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যাপক। জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-বিলাস সবকিছুকে অনেক আগেই বিসর্জন দিয়ে তিনি অর্জন করেছিলেন লাখো কোটি মানুষের আস্থা আর ভালোবাসা। স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন ‘ফকিরি জীবন’। বিশ্বমানবের সেবাই ছিল তাঁর ধর্ম। আবদুল সাত্তার ইধি পাকিস্তানের করাচিতে গড়ে তোলেন তাঁর এতিমখানা আর মানবসেবার প্রাণকেন্দ্র।
শুধু পাকিস্তান কেন, দুনিয়ার যেখানে মানুষ বিপদে পড়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিকম্প, সুনামি, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো দেশ হোক ইধি তাঁর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। দেশ, স্থান, কাল ও পাত্রের সীমানা অতিক্রম করেছেন। তাই ইধির কোনো দেশ ছিল না, বর্ণ ছিল না, কালকেও অতিক্রম করেছেন তিনি। ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে যখন একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দল পাকিস্তান ভ্রমণ করে তখন ওই প্রতিনিধি দলের সদস্য হবার সুযোগ হয়েছিল আমার। করাচিতে আমরা ইধির হোমে একটি বেলা কাটিয়েছিলাম। জীবনের অসাধারণ এক মুহূর্ত হয়ে আছে সেই স্মৃতিটি। আমরা সাংবাদিকরা তাঁর হোমের নানা কার্যক্রম দেখে দুপুরে ইধির চারপাশে গোল হয়ে বসলাম। সাংবাদিক সম্মেলন পরিণত হয়েছিল পরম মমতার এক চেনা মানুষের অভূতপূর্ব সান্নিধ্যে।
ছোটখাটো চেহারা, একমুখ বড় সাদা দাড়ি। কখনও-সখনও পরতেন ইসলামের ঐতিহ্যবাহী টুপি। গরীবদরদি এই মানুষটির হাত ধরেই গড়ে উঠেছে পাকিস্তানের সব চাইতে বড় সমাজকল্যাণ সংস্থা ইধি ফাউন্ডেশন। অনাথদের জন্য হোম, গরীবদের চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল ক্লিনিক, অ্যাম্বুলেন্স, আরও অনেক পরিসেবা দিয়ে যাচ্ছে এই ফাউন্ডেশন।
এত সাদাসিধে জীবন খবু কম দেখা যায়। হোমে আমরা জানলাম, তাঁর দুটি মাত্র পোশাক। একটি ধুয়ে দেন। সেটি শুকালে গায়েরটি পবিরর্তন করেন। কালো রঙের পোশাক পড়েছিলেন তিনি। খুবই কম কথা বলেন। মুখে এক চিলতে হাসি লেগে থাকে। তাঁর হোমে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া, সেলাইকাজ, নানা ধরনের হোম ওয়ার্কের মধ্য দিয়ে জীবনে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পরিশ্রমলব্ধ প্রচেষ্টা নিজের চোখে দেখেছিলাম।
অবাক হয়েছিলাম আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশের সাংবাদিক প্রতিনিধিদলটি। যখন আমাদের কেউ কেউ ইধি ফাউন্ডেশনের জন্য অল্প কিছু টাকা দান করতে চাইলাম, আমাদের জানানো হলো, বিদেশিদের দান ইধি ফাউন্ডেশন নেয় না। ভেবেছিলাম আমরা অতিথি তাই হয়ত দান গ্রহণযোগ্য নয়। পরে জানলাম, পাকিস্তানের নাগরিকদের কাছ থেকেই শুধু ইধি ফাউন্ডেশন দান গ্রহণ করে থাকে। আমরা এও জানলাম বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার তিনি এসেছেন।
ইধির হোম থেকে যখন ফিরলাম তখন আমাদের প্রত্যেকের হাতে তুলে দেয়া হয় তেহমিনা দুররানির লেখা ‘আবদুল সাত্তার ইধি, অ্যান অটোবায়োগ্রাফি, এ মিরর টু দি ব্লাইন্ড’ নামের বইটি। বইটিতে ইধির অটোগ্রাফও রয়েছে।
ইধি ছিলেন স্পষ্টবাদী। কখনও কাউকে তোয়াজ করেননি। জঙ্গি হামলার জন্য তেহরিক-ই-তালিবানকে যেমন আক্রমণ করেছেন, আবার দুর্নীতির জন্য দুষেছেন সরকারকে। সমাজের সর্বস্তরের, সবধর্মের মানুষ তাঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। নিজের সেবা দিয়েই তিনি সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। মানবসেবায় জাতপাত তিনি কখনই বিবেচনায় আনতেন না। বছর তিনেক আগে এক সাক্ষাৎকারে প্রবীণ এই মানুষটি বলেছিলেন, যন্ত্রণাকাতর মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে আমার অ্যাম্বুলেন্স যখন হাসপাতালে পৌঁছে দেয়, তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, তখন আমি পরম শান্তি পাই। কারণ, মানুষের সেবাই আমার মিশন। বলতেন, ‘আমার জীবনের প্রতিটা দিনই আমার কাছে সেরা দিন।’
মানুষের জন্য মানুষÑ যা নিয়ে প্রচলিত ধারণা আমাদের সমাজে আছে তার একটা অগ্রসরমান ধারণা পোষণ করতেন ইধি। এজন্য তাঁর এ চেতনা দেশ ও সীমানা অতিক্রম করে গেছে। পাকিস্তান থেকে এ কারণেই ইধি দুর্যোগের সময় চলে গেছেন অন্য দেশে। ইরানের বাম শহরে যখন ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় তখন ইধি সেখানেও ছুটে যান মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ত্রাণ পৌঁছে দেন। তেমনি তিনি ছুটে গিয়েছিলেন সুনামি কবলিত দেশগুলোতে। তাঁকে দেখা গেছে ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতায়। মানুষকে পুনর্বাসন ছাড়াও পীড়িতকে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা, খাবার সরবরাহ, শীতার্তদের কাপড় দেয়াসহ দুস্থদের জন্য নানা ধরনের কর্মসূচি ইধি ফাউ-েশন করে আসছে। পাকিস্তান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, দুবাই, আফগানিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, ইয়েমেন ও রাশিয়ায় ইধি ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে।
ইধি তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, যখন তিনি শিশু ছিলেন তখন তাঁর মা তাঁকে স্কুলে যাওয়ার সময় দু’টি পয়সা দিতেন। একটি পয়সা তাঁর জন্য এবং আরেকটি পয়সা অপরের জন্য খরচ করতে। ইধি অনেক সময় অন্য কারো জন্য পয়সাটি খরচ না করতে পারলে তাঁর মা তাঁকে তিরস্কার করতেন। মা বলতেন, ইধি তুমি কেমন করে অন্যের প্রয়োজনের কোনো তালাশ না করে থাকতে পার? এভাবে অন্যের প্রয়োজনের দিকে নজর না দিয়ে শুধু নিজের প্রয়োজন মেটানো এক ধরনের স্বার্থপরতা এবং লোভী হিসেবে নিজেকে সংকীর্ণতায় সঁপে দেয়া বলেও ইধিকে তাঁর মা সাবধান করে দিতেন। ইধির বাবা একজন বিধবা মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন।
ইধি তাঁর এই মা-কে সারাজীবন শুধু সেবা করার সুযোগ পাননি, কীভাবে মানুষের জন্য সেবা করে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে হয় তার শিক্ষাও পেয়েছেন। ইধি ছোটবেলা থেকেই অবসরে দুঃস্থ মানুষের জন্য কী প্রয়োজন তার খোঁজে ও প্রয়োজন মেটাতে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতেন। ইধির মা নিজে মহিলাদের জন্য সমিতির মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতেন। প্যারালাইসিস ও ডায়বেটিসের রোগী হয়েও ইধির মা অন্যের জন্য নিজের সময় যেভাবে ব্যয় করতেন তা দেখে শৈশব থেকেই ইধি পরোপকারী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। আগে থেকেই রেকি করে আসতেন কার ঘরে খাবার নেই, ওষুধ কিনতে পারছে না কোন পরিবার। তারপর কিশোর ইধি খাবার কিংবা ওষুধের প্যাকেট কিংবা টাকার ইনভেলাপটি ওই বাড়ির জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন দৌড়, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যাবার সময় পাকিস্তান ও ভারতে লাখ লাখ শরণার্থী অভিবাসী হিসেবে দেশ পরিবর্তন করেন। নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানের করাচিতে ইধির পরিবার চলে আসে। ইধির বয়স তখন কুড়ি বছর। তখন থেকেই ইধি শরণার্থীদের দেখভাল করতেন। প্রথমে পেন্সিল, ছোট ছোট তোয়ালে, ব্লেড ফেরি করে রাস্তায় রাস্তায় বেচতেন ইধি। এরপর পানের দোকান, ক্রোকারিজের দোকান, পত্রিকার হকারি অর্থাৎ একের পর এক জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য লড়াইয়ের পাশাপাশি শরণার্থীদের দেখভাল করতে সমিতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এধরনের সামাজিক কাজ করতে গিয়ে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়েছে, তবু মানুষের সেবা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি ইধি।
মানুষের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানো নিয়ে যে প্রচলিত ধারণা আছে আমাদের সমাজে, তার সঙ্গে বেশ বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে ইধির। তিনি মনে করেন মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা শুধু দায়িত্ব নয়, কঠিন কর্তব্য শুধু নয়, এ হচ্ছে ঝড়ো হাওয়াময় উত্তাল সাগরে নিজেকে সঁপে দিয়ে মানুষের কল্যাণে স্বর্গসুখ অনুভব করা। তিনি বলেন, ধামাধরা কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের সেবা করা সম্ভব নয়। যতক্ষণ না মানুষের দুর্ভোগ নিজের অনুভবে সম্পৃক্ত করা না যায় ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের দুর্দশা দূর করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ ধরনের অনুভবের অভাবই বরং এক ধরনের নৃশংস ব্যাপার হয়ে সমাজে বিরাজ করে। যা অনেকেই বুঝতে চান না।
১৯৫৭ সালে করাচিতে ভয়াবহ ধরনের ফ্লুতে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তখন ইধি তাঁবুর ব্যবস্থা করে, ওষুধ সংগ্রহ করে চিকিৎসা সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। পাকিস্তানে অন্তত ৩শ’ ক্লিনিক, কয়েক হাজার অ্যাম্বুলেন্স, অসংখ্য ভ্রাম্যমান ক্লিনিক, ৮টি হাসপাতাল, একটি ক্যান্সার হাসপাতাল, আইনি সহায়তা, কুড়ি হাজার পরিত্যক্ত শিশুকে শিক্ষাদীক্ষায় মানুষ করে তোলা, এতিমখানাগুলোতে ৫০ হাজার ছেলেমেয়েকে প্রতিপালন এবং অন্তত ৪০ হাজার নার্সকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বছরের পর বছর অন্ধকারে আলোর যে প্রদীপ জ্বালিয়ে গেলেন ইধি তা মানুষকে মহৎ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে আজীবন। কত বিনিদ্র রাত ও দিন ইধির কেটেছে মানুষের কল্যাণে তার খোঁজ কে রাখে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইয়েমেন যেখানেই বোমা বিস্ফোরণে নিরীহ মানুষ আহত হয়ে কাতরায় সেখানেই ইধির অ্যাম্বুলেন্স ছুটে যায় তাদের জীবন বাঁচাতে। কয়েক বছর আগে করাচিতে প্রচ- তাপদাহে অন্তত ১ হাজার মানুষ মারা যায়। তখন ইধির অ্যাম্বুলেন্সগুলো দিনরাত ছোটাছুটি করে মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে। আর এসব আয়োজনের জন্য ইধি রাস্তায় রাস্তায় মানুষের কাছে হাত পেতেছেন।
অসাধারণ এক সাদাসিধা জীবন ছিল ইধির। সামান্য সব্জি কিংবা ডাল রুটি পেলেই খাওয়া হয়ে যেত তাঁর। কলকাতায় মাদার টেরেজার মতো মানবকল্যাণে নিবেদিত ইধিকে দেখতেন ভারতের মানুষ। গান্ধী শান্তি পুরস্কার, ইউনেস্কো মদনজিত সিং পুরস্কার, লন্ডন পিস অ্যাওয়ার্ড, সিওল পিস অ্যাওয়ার্ড, হামদান অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য পুরস্কার পিছু নিয়েছে ইধির। কিন্তু ইধি মানুষের জন্য সারাজীবন ছোটাছুটি করেছেন। খ্যাতির পেছনে তাঁর কোনো ফুরসত ছিল না। ইধির ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁকে তাঁর গ্রামে দাফন করা হয়। তিনি তাঁর চোখ দু’টি দান করে গেছেন। এ ব্যাপারে ইধির বক্তব্য ছিল, ‘কেন আমরা আমাদের মৃতদেহের অপচয় করব; বরং কবরে যাওয়ার আগে যদি কারো জন্য উপকারে লাগতে পারি এবং একজন অভিভাবক হিসেবে তাই করা উচিত।’
একবার রোম রেলস্টেশনে ইধি তাঁর পায়ের চপ্পল জোড়া হারিয়ে ফেলেন। কি আর করা, খালি পায়ে ইধি ঘরে ফিরলেন। পরদিন তাঁকে এক জোড়া গামবুট দেন এক বৃদ্ধা। তা পায়ে বড় হলেও সেটাই পড়ে তিনি চলতে শুরু করেন তাঁর গন্তব্যে। কারণ, তাঁর গন্তব্য ছিল লক্ষ্যভেদি ও স্থির। ব্রিটিশ সরকার একবার তাঁকে লন্ডনে থেকে যেতে অনুরোধ করেছিল। চাকরিও জুটেছিল। কিন্তু তা সম্মানের সাথে প্রত্যাখ্যান করে ইধি বলেছিলেন, পাকিস্তানের মানুষের জন্য আমাকে কিছু কাজ করতে হবে। অথচ পাকিস্তান ইধিকে পাওয়ার আগে কল্যাণময়ী রাষ্ট্র ছিল না। ইধি এ অভাব অনেকটাই পূরণ করেছেন। এজন্য তাঁকে অনেক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে। জীবনে প্রথম এক রেলভ্রমণে তুরস্কের এক নারীকে তাঁর ভালো লেগেছিল। ব্যস ওইটুকু পর্যন্তই। এরপর অন্তত সাতজন নারীর বিয়ের প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন ইধির কখনই ছিল না। তিনি তাঁর সময় ও শক্তিকে ব্যয় করেছেন মানুষের অসময় ও শক্তিহীনের মাঝে। মৃতদেহ সংগ্রহ করা, থানায় পুলিশের সঙ্গে বোঝাপড়া করে অসহায় মানুষের মুক্তির ব্যবস্থা, ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য অপেক্ষা, কেউ যদি কোনো মৃতদেহের দাবি না করে তাহলে তাকে নিজের স্বজন হিসেবে দাফন করার মতো সময়ের ঘাটতি যাঁকে পীড়া দিত তাঁর প্রিয়তমাকে দেয়ার মতো মধুর সময় কি করে হতে পারত!
ইধি নিজেও আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আমি বুঝি মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর বিড়ম্বনা। তারা সেবার পর তাঁদের হাত ধুয়ে ফেলেন। কাপড় ধুয়ে ফেলেন। শুঁকে দেখেন কোনো দুর্গন্ধ অবশিষ্ট আছে কি না। তাঁরা ঘরে দৌড়ে যান গোসল করার জন্য। আমি তখন ফুলে ফেঁপে ওঠা অসহায় মৃতদেহগুলো সাগর থেকে তুলে আনি। কালো মানুষের শরীর ভেসে যায় নদীতে। আমি তাকে কোলে তুলে আনি। গর্ত থেকে কাউকে উদ্ধারের জন্য ছুটি। ম্যানহোলের ভেতর থেকে আর্তনাদ শুনে তাকে উদ্ধারের জন্য দৌড়ে যাই। আগ্নিদগ্ধ কাউকে বাঁচাতে, সেতুর নিচে নিমজ্জিত কাউকে তুলতে, রেল সেতু ভেঙে যে বগিতে আটকে আছে মৃতদেহ হয়ে তাকে, নর্দমায় কোনো শিশুকে, রাস্তায় কোনো অসহায় ব্যক্তিকে, কারণ, কোনো কর্তৃপক্ষ কিংবা তার স্বজন তাকে অস্বীকার করেছে, না হয় দূরে ছুঁড়ে ফেলেছে।
পাকিস্তান ভ্রমণের সময় করাচিতে ইধি ফাউ-েশন থেকে বের হতে মন চাইছিল না। আমাদের হাতে তুলে দেয়া ইধির আত্মজীবনীটি নাড়াচাড়া করছিলাম। বইটিতে ইধির একটি ফটোগ্রাফ দেয়া আছে। সাদা ধবধবে দাড়ি আর তার মুখম-লের একপাশে অন্ধকার ভর করেছে। অনেকটা আবছা। মনে হয় আমাদের সমাজে যে অন্ধকার রয়েছে তা দূর করেই আলো হয়ে ইধি ওই ছবিতে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার ছবি দেখে কবি বা বিপ্লবী মনে হয়েছে। কিন্তু কেন? জীবনকাব্যের মহানায়ক ছিলেন ইধি। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। পাকিস্তানের মতো দেশে অনেক নারীকে বিয়ে বহির্ভূত সন্তান জন্মদানের জন্য হত্যা করা হতো। এটি শুনে ইধি একবার এক মসজিদের সামনে গিয়ে দেখেন সদ্যভূমিষ্ঠ একটি শিশুকে পাথর ছুঁড়ে মেরে হত্যার জন্য জড়ো হয়েছে কিছুসংখ্যক মানুষ। তথাকথিত ধর্মীয় নেতারা এ আদেশ দিয়েছেন। ইধি তাঁদের সামনে গিয়ে প্রশ্ন তুললেন, কে এই সদ্যজাত মানুষকে পাপী হিসেবে হত্যার ফতোয়া দিয়েছে, যখন নিরপরাধ কোনো মানুষকে হত্যার কোনো আদেশ দেয়া হয়নি? তাই পিতৃপরিচয়হীন সন্তানকে হত্যা করে আরেকটি জঘন্য পাপ করার আগে তাদের ইধি ফাউ-েশনে দিয়ে দিতে আহবান জানাতেন তিনি। এভাবে অন্তত ৩৫ হাজার পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানকে মানুষ করেছেন যাদের পরিত্যক্ত হিসেবে তার অভিভাবক বা স্বজনরা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। এ নিয়ে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে ইধির কম মনোমালিন্য হয়নি। তাঁরা বলতেন, এসব সন্তান কখনো তাদের পিতার পরিচয় পেলেও তার সম্পদের অধিকার পাবে না। ইধি তাঁদের বলতেন, আল্লাহর নির্দেশকে যারা তুচ্ছ বিবেচনা করে থাকেন তাদের সাবধান হওয়া উচিত।
দুর্নীতির জন্য সাধারণ মানুষ যে চরম বৈষম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছিল তাদের সম্পর্কে ইধি একাধিকবার বিভিন্ন সমাবেশে শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এভাবে দুর্নীতি চলতে থাকলে বঞ্চিত মানুষ একদিন পাগলের মতো উঠে আসবে এবং ক্ষমতার তখতে তাউস ভেঙে ফেলবে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করে তিনি অনেক সময় তাদের স্বঘোষিত ডাকাত বলেও অভিহিত করতেন। অনেক সময় পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের বন্দুক যুদ্ধের মধ্যে ইধির অ্যাম্বুলেন্স আটকে যেত আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময়। ইধি বলতেন পুলিশের উচিত বন্দুক যুদ্ধের সাময়িক বিরতি দেয়া। কারণ, যতক্ষণ না আহত মানুষকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে রওয়ানা না দেয়া যায় ততক্ষণ ক্ষণিকের জন্য হলেও গোলাগুলি বন্ধ করা উচিত।
একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি হচ্ছেন ইধির সহধর্মিনী বিলকিস। ইধির দিনভর আর্তের জন্য ছোটাছুটি ও ব্যক্তিগত কঠোরতা বিবাহিত জীবনের জন্য সহায়ক ছিল না। আবার তাঁর ভাই আজিজ, যাঁকে তিনি গড়ে তুলেছেন, শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছেন এসবই পাওয়া যায় তাঁর আত্মজীবনীতে। ইধির পরিবার যখন হজে যায়, তখন অ্যাম্বুলেন্সে চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকায় তাঁর স্ত্রী বিলকিস অতিরিক্ত কাপড় সঙ্গে নিতে পারেননি। একবার কোয়েটায় যখন তীব্র গরম পড়ে, তখন ইধি তাঁর স্ত্রীর জন্য রাশিয়ার সৈনিকদের ব্যবহৃত একটি ওভারকোট কিনে দেন। ইধির মেয়ের বিয়েতে উপস্থিত থাকার মতো সময় তাঁর হয়নি। কিন্তু ইধির স্ত্রী বিলকিস এসব ঝামেলা সহজেই সামলিয়েছেন। কারণ, তিনি জানতেন তাঁর স্বামীকে যে কোনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক দুর্যোগের সময়Ñ তা লেবাননের গৃহযুদ্ধ থেকে এমনকি বাংলাদেশের সাইক্লোনে দুর্গতদের সাহায্যের জন্য ছুটতে হয়।
কোনো আতঙ্কই ইধির অ্যাম্বুলেন্সের চালকদের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, সাহসী সৈনিকদের মতোই তাঁরা দুর্গতদের তুলে হাসপাতালে পৌঁছে দেন, তা দুর্যোগ কিংবা গোলাগুলির মধ্যেই হোক না কেন। ইসলামে যে মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতার কথা বলা হয়েছে তারই মূর্তমান প্রতীক ছিলেন ইধি। তিনি নিজেও বলতেন, যতক্ষণ না আর্তের আর্তনাদ না থামবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের পাশে দাঁড়াতে তিনি ছুটে যাবেন এবং এই ছুটে যাওয়ার মধ্যেই তিনি কল্যাণ দেখতে পেতেন।
নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের সময় ডটকম