বৃহস্পতিবার, ৪ঠা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২০শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

অমর একুশে ও মাতৃভাষা

পোস্ট হয়েছে: জুন ১৫, ২০২১ 

অমর একুশে ও মাতৃভাষা
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন

সময়ের বিবর্তনে প্রতি বছরই বাঙালির অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে ফিরে আসে অমর একুশে। আমরা আবেগাপ্লুত হই, গ্রন্থমেলার আয়োজন করি, সভা-সমাবেশ, আলোচনা, বক্তৃতা-বিবৃতি, ভাষণ, স্মৃতিচারণ আর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে শহিদদের স্মরণ করি। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মাতৃভাষার প্রতি এই অকৃত্রিম দরদবোধে আমরা তাড়িত হই এবং এ মাসের নির্ধারিত কিছু কর্মসূচি সম্পন্নকরণের ভেতর দিয়েই মায়ের ভাষার প্রতি সকল দায়-দায়িত্ব পালন হয়ে যায়Ñ এমনটিও অনেকে ধরে নেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মহান স্রষ্টার অন্যতম সেরা উপহার মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধের জায়গাটি অনেকটাই বিস্তৃত, প্রসারিত; খুবই প্রথাসিদ্ধ কিছু আচার-অনুষ্ঠান উদ্যাপনে এ দায়িত্বের হকটুকু আদায় হয়ে যাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বাঙালির মায়ের ভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি অর্জন করায় ঐতিহাসিক এ ভাষার উন্নয়ন ও বিস্তারে আমাদের দায়িত্ব-পরিসরের দিগন্তটি আরো ব্যাপক আকারে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে; যাকে সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারের বা প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানে শিকলাবদ্ধ করার আর কোনো উপায় নেই। বিশেষ করে অন্তত নিজেদের সমাজ-কাঠামো ও রাষ্ট্রের সর্বত্র মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন এখনো হয়ে উঠেনি; যা বায়ান্ন’র ভাষা শহিদদেরই শুধু অবমূল্যায়ন নয়, বরং জাতি হিসেবে আমাদের জন্যে চরম ব্যর্থতা ও লজ্জারও বিষয় বটে।
মাতৃভাষার মর্যাদা ইসলামে স্বীকৃত। মহানবি (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। বায়হাক্বি শরিফের একটি হাদিসে তাঁর আরবিপ্রীতির বিরল নজির পাওয়া যায়। তিনি বলেন : ‘তোমরা তিন কারণে আরবদের ভালবাসবে। প্রথমত আমি আরব, দ্বিতীয়ত পবিত্র কুরআনের ভাষা আরবি এবং তৃতীয়ত জান্নাতবাসীদেরও ভাষা হবে আরবি।’ রাসূল (সা.)-এর উল্লিখিত বাণীর পরিপ্রেক্ষিতে মাতৃভাষার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একইভাবে এর মাধ্যমে অপরাপর সকল ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর স্ব-স্ব ভাষার গুরুত্বও বৃদ্ধি পেয়েছে। মাতৃভাষার গুরুত্ব আমাদের কাছে আরো বেড়ে যায় যখন দেখি মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকে তাঁর জাতির মাতৃভাষাতেই প্রেরণ করেছি; যাতে তিনি আল্লাহপাকের বাণী সহজেই তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেন’ (১৪:৪)। মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের বাণীর মাধ্যমে মাতৃভাষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া যায়।
পৃথিবীর সকল জনপদে তাদের নিজ নিজ ভাষা রয়েছে; যা তাদের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং প্রাত্যহিক মনের অব্যক্ত বিষয়াবলি প্রকাশের তথা জীবন-যাপনের প্রিয় ভাষা। মমতাময়ী মায়ের কাছ থেকে প্রথম সে ভাষা শিখে বিধায় তার নামকরণ করা হয়েছে মাতৃভাষা হিসেবে। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ছয় সহ¯্রাধিক ভাষার মধ্যে এক এক জনপদের লোকেরা তাদের সেই প্রিয় মাতৃভাষায় কথা বলে থাকে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর বাণীÑ ‘আমার নিদর্শনসমূহের মাঝে রয়েছে নভোম-ল ও ভূম-ল সৃষ্টি এবং ভাষা ও বর্ণের মধ্যে পার্থক্য; জ্ঞানীদের জন্য এতে সুনিশ্চিত অনেক নিদর্শন রয়েছে’ (৩০:২২)। পৃথিবীর অপরাপর সকল জিনিষের মতো মাতৃভাষার ¯্রষ্টাও স্বয়ং মহামহিম আল্লাহ। তিনি বলেন : ‘তিনিই মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে মনের ভাব-বর্ণনা (ভাষা) প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন’ (৫৫:৩-৪)।
মানবসমাজে অমানিশার ঘোর তমসাচ্ছন্নতার অবসানে আর অজ্ঞতা-মূর্খতার অন্ধকার দূরীকরণে মহান আল্লাহ সময়ের ব্যবধানে তাঁর নির্বাচিত প্রিয়পাত্রদের প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা ও মর্যাদা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। মানুষ ও মানবতার সকল অপ্রাপ্তি পরিপূরণে ও পার্থিব-অপার্থিব সার্বিক সফলতা অর্জনের মানসে নাযিলকৃত সকল আসমানি গ্রন্থ স্ব-স্ব পয়গম্বরের মাতৃভাষাতেই প্রচারিত হয়েছে। আমি সব পয়গম্বরকেই তাঁদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাঁরা তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারেন’ (১৪:৪)। হযরত আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘আল্লাহপাক প্রত্যেক নবিকে তাঁর স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন (আহমদ)।’ আল্লাহর বাণীবাহক হযরত মূসা (আ.)-এর মাতৃভাষা ছিল ইবরানি, তাই এ ভাষাতেই মহান আল্লাহ তাওরাত কিতাব নাযিল করেছেন। একইভাবে হযরত দাউদ (আ.)-এর মাতৃভাষা ইউনানিতে জাবুর কিতাব, হযরত ঈসা (আ.)-এর মাতৃভাষা সুরিয়ানিতে ইঞ্জিল কিতাব আর সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবিতে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহপাক বলেন : ‘এই কোরআন বিশ্ব-জাহানের পালনকর্তার নিকট থেকে অবতীর্ণ। বিশ্বস্ত ফেরেশতা জিব্রাইল একে নিয়ে অবতরণ করেছে। আপনার অন্তরে, যাতে আপনি ভীতিপ্রদর্শনকারী হতে পারেন। আর এ মহাগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়। নিশ্চয়ই এর উল্লেখ আছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে’ (২৬:১৯২-১৯৬)। মহানবি (সা.) মাতৃভাষাতেই পবিত্র কোরআনের বাণী প্রচার করেছেন। মাতৃভাষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম।
আল-কোরআনে রয়েছেÑ ‘হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও’ (৪৯:১৩)। পৃথিবীতে নানান জাতির বসবাস এবং তাদের মনোভাব প্রকাশের জন্য মাতৃভাষাও রয়েছে। সেই মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে তুরষ্ক, বুলগেরিয়া, মধ্য এশিয়ার অঞ্চলসমূহ আর ভারতের উত্তর প্রদেশসহ বিশ্বের কিছু জাতিগোষ্ঠীকে। কিন্তু বাঙালি জাতি কেবল আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলার মানুষকে জীবনও দিতে হয়েছে। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন মোতাবেক ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে রচিত হয়েছে অমর এক শোকগাথা; যেখানে শাহাদতের সুধা পান করতে হয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেককেই। বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মায়ের ভাষাকে মুক্ত করেছে। যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরো গভীরে নিয়ে গেছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের উচিত বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চা করা। বাংলাকে সকল বিকৃতি থেকে রক্ষা করা।
মহান ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ধারণা থেকে আমরা বলতে পারি, ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষার এই আন্দোলনের প্রধানত উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষা বাংলার অবাধ ব্যবহার ও তার সার্বিক উৎকর্ষ বিধান এবং সর্বস্তরে চর্চার অধিকার আদায় করা। অপর উদ্দেশ্যটি ছিল মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সরকারি-বেসরকারি সকল অফিস-আদালতসহ রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানে এর যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং জাতীয় স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তা বজায় রাখা ও সারাবিশ্বে এ ভাষার পরিচিতি আরো উন্নত পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া। আর সেজন্যই আমাদের ভাষা আন্দোলনের মূল সেøাগানই ছিলÑ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ভাষা আন্দোলনের আরেকটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল জাতি হিসেবে বাঙালির সকল গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখের ভাষার পরিবর্তে সংখ্যালঘিষ্ঠ কোনো জাতির ভাষা এখানে চাপিয়ে দেওয়া কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না; বরং তা সভ্যতা ও মূল্যবোধের চরম পরিপন্থী। এরকম একটি অগণতান্ত্রিক, অন্যায় ও মানবাধিকার পরিপন্থী বিষয়ের তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে গিয়েই মহান ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল; যা পরবর্তীতে বাঙালি জাতির জন্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূরীকরণে পর্যায়ক্রমে এক ঐতিহাসিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রূপ পরিগ্রহ করেছিল। আর এক্ষেত্রে অমর একুশের অকোতভয় বীর শহিদদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মহানবি (সা.) ছিলেন আরবের সবচেয়ে সুন্দর ও শুদ্ধভাষী। তিনি কোনোদিন একটি অশুদ্ধ বা বিকৃত শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করেননি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শহিদদের অবদান এবং মহানবি (সা.)-এর মাতৃভাষা প্রীতির অজস্র নজির সামনে রেখে এ বিষয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখতে পাই, আরবের অধিবাসীদের নীতিবিধান, জীবনবোধ ও সামগ্রিক আচার-পদ্ধতি সহজে বোঝাবার জন্যই আরবি ভাষাতে কোরআন নাজিল হয়েছিল। আর তা আল্লাহপাকের এক বাণীতেও পরিষ্কার অনুধাবন করা যায়Ñ ‘আমি একে আরবি ভাষায় কোরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পার’ (১২:২)। মহান আল্লাহর এ নির্দেশনার আলোকে আমাদেরও উচিত সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার যথার্থ প্রচলন এবং বাংলা ভাষার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আনয়ন। বাংলা ভাষার কবি, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক, প্রতিবেদকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত তাঁদের রচনায় আমাদের শিশু-কিশোরসহ অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষের সহজে বোধগম্য হয় এমন শব্দাবলির ব্যবহার করা। ভিন্ন ভাষায় রচিত গ্রন্থাদি সহজবোধ্য ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে উপস্থাপন বাঞ্ছনীয়। ধর্মীয়, নৈতিক ও শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধীয় সকল রচনা মাতৃভাষায় ভাষান্তর হওয়া প্রয়োজন; যাতে ইসলামকে বুঝতে সহজ হয়, নৈতিক জ্ঞানে মানুষেরা গুণান্বিত হয় এবং বিদেশী রচনাবলির স্বাদ বাংলায় আস্বাদন করতে সক্ষম হয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়